দৌড় আবার কোনও খেলা হতে পারে নাকি!
বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না সতেরো বছরের ছেলেটার। “আমার কাছে তো দৌড় মানে জীবন। যত বার দেখেছি মরে যেতে পারি, তত বার শুধু দৌড়ে গিয়েছি। প্রাণ হাতে করে। সেই কাজটা খেলাচ্ছলে করব কী করে!” |
ট্র্যাকে নামার প্রস্তাব পেয়ে ভিনদেশি স্কুলের অচেনা প্রশিক্ষককে এই কথাগুলোই বলেছিল গুওর মারিয়াল। সেটা ২০০২ সাল। নিজের দেশ, গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সুদান ছেড়ে মিশরে কিছু দিন কাটিয়ে সবে সে আশ্রয় নিয়েছে মার্কিন মুলুকে। নিউ হ্যাম্পশায়ারের কনকর্ডে কোনও মতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে। বাঁচতে গেলে দৌড়তে হবে, কামান-বেয়নেটের সামনে কাটানো শৈশবের এই শিক্ষাটাই তখন তার একমাত্র পাথেয়। ঘরবাড়ি, বাবা-মা ছেড়ে এটুকুই সে নিয়ে এসেছে বুকে করে। বাঁচার লড়াই খেলা হয় কী করে, সেটাই মারিয়ালের কাছে বিশাল প্রশ্ন। প্রশিক্ষক রাস্টি কফরিন হাল ছাড়েননি। বন্ধুদের বলেছিলেন, “বাচ্চাটা ট্র্যাকে ভেসে বেড়ায়!”
সেই মারিয়ালই কাল পা রাখবেন লন্ডন অলিম্পিকের ম্যারাথনের ট্র্যাকে। কোনও দেশের প্রতিনিধি হয়ে নয়, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির পতাকা নিয়ে। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে! |
২০০২
এত দিন তো দৌড়েছি শুধু প্রাণে বাঁচতে।
২০১২
আজ দৌড়চ্ছি সারা বিশ্বের প্রতিনিধি হয়ে।
গুয়োর মারিয়াল |
|
২০০২ থেকে ২০১২দশটা বছর পেরিয়ে সতেরো বছরের ছেলেটা এখন আঠাশ ছুঁইছুঁই যুবক। আজও ঘরে ফেরা হয়নি। এর মধ্যে বদলে গিয়েছে দেশটাও। সুদান ভেঙে তাঁর জন্মস্থান এখন দক্ষিণ সুদানে। বাবা-মা’কে শেষ দেখেছিলেন ১৯৯৩ সালে। জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছিল আট ভাইবোন। তাদের কথাও মনে পড়ে সব সময়। তাঁর ফেলে আসা গ্রামটায় আজও পাঁচ দশক চলা গৃহযুদ্ধের ক্ষত। তবু নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি মারিয়াল। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত শৈশবের বেঁচে থাকার সেই দৌড়কে বদলে দিয়েছেন সাফল্যের উড়ানে।
তা-ও অলিম্পিকে নামার ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল। আমেরিকার ‘গ্রিন কার্ড হোল্ডার’ হলেও মারিয়াল সেখানকার নাগরিক নন। তাই মার্কিন মুলুকের প্রতিনিধিত্ব তিনি করতে পারবেন না। তাঁর জন্মস্থান দক্ষিণ সুদান মাত্র ১৩ মাস আগে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেখানে এখনও কোনও অলিম্পিক কমিটি বা দল নেই। দেশের বাইরে, পাসপোর্টও নেই মারিয়ালের। কিন্তু তাতেই দৌড়টা থেমে যায়নি। তাঁর কাহিনি শুনে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি জানায়, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এমন এক উদাহরণ মারিয়াল, যাঁকে ম্যারাথনের ট্র্যাকে নামাতে পারাটাই তাদের কাছে গর্বের বিষয়। কমিটির মুখপাত্র মার্ক অ্যাডামস জানান, আন্তর্জাতিক আইন দেখে মারিয়ালকে ‘উদ্বাস্তু’ স্বীকৃতি দিয়ে কাগজপত্র তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত হয়, অলিম্পিক কমিটির পতাকাতেই প্রথম ‘স্বাধীন’ খেলোয়াড় হিসেবে ম্যারাথনে দৌড়বেন মারিয়াল।
|
সুদানে গৃহযুদ্ধে খুন হয়েছে তাঁর ৮ ভাইবোন। জন্মেছিলেন যেখানে, সে দেশ এখন দক্ষিণ সুদান। বিশ্বের কনিষ্ঠতম দেশ। খুন-ধর্ষণ, লুঠতরাজের পাশাপাশি নখ উপড়ে ফেলা, শিশুদের গলায় জ্বলন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে দেওয়া গত পাঁচ দশকে সবই দেখেছে এই দেশ। না আছে অলিম্পিক দল, না আছে অলিম্পিক কমিটি। গুয়োর তাই ছুটবেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক পতাকা বুকে নিয়ে। |
|
বিশ্ব নাগরিকত্ব যে তাঁকেই মানায়।
তাই হয়তো দু’দশক পর ছেলেকে অন্তত টেলিভিশনে দেখতে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ হাঁটবেন মারিয়ালের বাবা-মা! যে গ্রামে টিভি রয়েছে, ভরা বর্ষায় সেখানে যাওয়ার গাড়ি মিলবে না যে। বিদ্যুৎহীন গ্রামে হঠাৎ চালু মোবাইল পেলে তবে ছেলের গলা শুনতে পান তাঁরা। দেখা তো হয় না। আগামিকালও দক্ষিণ সুদান সীমান্তে তেলের
খনির জন্য লড়াই চলবে। সেগুলো পাশে ফেলেই ওঁরা হেঁটে যাবেন। ছেলে জিতুক বা হারুক, শুধু খেলার জন্যও কেউ দৌড়তে পারে, এটাই তাঁরা দেখতে চান।
কবে কী ভাবে ‘দৌড়’ শুরু করেন মারিয়াল? লন্ডনে বসে শৈশবের পাতাগুলো নিজেই ওল্টাচ্ছিলেন। বলছিলেন, “দক্ষিণ সুদানের ওই গ্রামগুলোয় জোর যার, মুলুক তার। ছোটবেলায় জানতেও পারিনি ওই গ্রামের বাইরেও একটা জগৎ আছে। বাবা-মা’ও আজন্ম এগুলোই দেখেছে। ওরাও জানত না বাইরের পৃথিবী কী।” মারিয়াল যখন ১০ বছরের, জঙ্গিদের হাতে ভাইবোনেরা খুন হয়। চোখের সামনে বাড়িটাও পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
সেখান থেকেই দৌড় শুরু।
বাড়ি থেকে পালিয়ে এক কাকার বাড়ি যাচ্ছিল কিশোর মারিয়াল। কিন্তু সুদানের সেনার হাতে ধরা পড়ে শ্রমিক ক্যাম্পে কাজ করতে শুরু করে। তাদের চোখে ধুলো দিয়েও লাভ হয়নি। ফের এক সেনাকর্তার কবলে পড়ে শুরু হয় ক্রীতদাসের জীবন। মরেই যেত, তাই বাঁচার জন্য ফের দৌড়। এ বার সেনার রাইফেলের বাঁট তার চোয়াল ভেঙে দেয়। তবু দৌড়ে গিয়েছে ছেলেটা। টানা ছ’বছর। ২০০২-এ আমেরিকায় না পৌঁছনো পর্যন্ত। সেখানেই রসায়নে ডিগ্রি। তার পরেই ক্যালিফোর্নিয়ার এক আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ। তা-ও এক ম্যারাথন দৌড়েই। আর সেই বন্ধু ব্র্যাড পুওরের অক্লান্ত লড়াইয়েই মারিয়াল আজ বিশ্বক্রীড়ার মঞ্চে।
মারিয়ালের এই দৌড় মনে করিয়ে দেয় ভারতের ‘উড়ন্ত শিখ’ মিলখা সিংহের কথা। দেশ ভাগের দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়েছিল তাঁরও শৈশব। চোখের সামনে বাবা-মা’কে খুন হতে দেখেছিল কিশোর মিলখা। বাঁচার জন্য রক্তমাখা জামা পরেই আতঙ্কের দৌড় শুরু করেছিল। যা এক দিন তাঁকে পৌঁছে দেয় অলিম্পিকে।
মিলখা-মারিয়ালদের বুঝি এ ভাবেই মিলিয়ে দেয় জীবনের ম্যারাথন!
|
আজ |
কুস্তি
• সুশীল কুমার(দুপুর ১২-৩০) |
ম্যারাথন
• রাম সিংহ যাদব (দুপুর ৩-০০) |
গত কাল |
হকি
• দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হার |
কুস্তি
• রেপেশাজে ব্রোঞ্জ যোগেশ্বরের |
হাঁটা • বসন্ত বাহাদুরের বিদায় |
|