কত স্বাধীনতা দিবস এল ও গেল, পুরুষ আজও মেয়েদের
ওপর
নজরদারির জোয়াল কাঁধে ঘুরছে। সমবেদনা জানাচ্ছেন সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
বেচারা রাজার ভারী দুখ সত্যি, ভাবলেও বুকের ভেতরটা কশকশ করে ওঠে। এমনধারা একটা প্রজাতি, এত উন্নত, বুদ্ধি অশনি-সম ক্ষুরধার, মেধা সমুদ্রের ন্যায় পরিব্যাপ্ত, আর তারা কিনা শেষমেশ দারোয়ান! আমার তো মায়ায় চোখ ছলছল করে ওঠে। এত অন্যায় এরা মেনে নেয় কী করে? এমন কাজ দিয়ে পৃথিবীতে কোনও শত্তুরকেও যেন পাঠানো না হয়। প্রতি পলে এত অবিচার! স্বাধীনতার ছিটেফোঁটাও জুটল না এদের ভাগ্যে!
আজ্ঞে, আমি পুরুষ-প্রজাতির কথা বলছি। এক বারও ভেবে দেখেছেন, এরা কত পরাধীন? আমরা শুধু গলা ফাটাই নারীর স্বাধীনতা, নারীর অধিকার নিয়ে। পুরুষদের কথা তো এক বারও ভেবে দেখি না! এদের পূর্ণ বিকাশ, পূর্ণ স্বাধীনতা কখনও মর্যাদা পায় না। কারণ এরা দু’দণ্ড নিজেকে নিয়ে তাকাতে পারে না, সর্বক্ষণ অন্যের কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়।
এই পরাধীনতার শুরু কিন্তু সভ্যতার আদি থেকে। যেই না মোটামুটি একটা চাষবাসওয়ালা সভ্যতার সৃষ্টি হল, কৃষিকাজ শুরু হল, জমির মালিকানা চালু হল, অমনি ছেলেরা পরাধীন হয়ে গেল। কেন? অন্য এক প্রজাতির ওপর খবরদারি, পুলিশগিরি করার স্বনিযুক্তি প্রকল্পে নাম লেখাল তারা। সেই প্রজাতির নাম নারী। নারী কী করবে এবং নারী কী করবে না মূলত এই রুলবুক তৈরি করতে করতে এবং সেই রুটিন মানা হচ্ছে কি না সেই নজরদারি নিষ্ঠাভরে পালন করতে করতে বেচারারা নিজেদের সত্যিকারের অস্তিত্ব খুইয়ে বসল। তাদের এ ধরাধামে কী করতে পাঠানো হয়েছিল, সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। তার পর কত পুরুষ কেটে গেল, দাসত্ব ঘুচল না।
অথচ, মেয়েদের প্রতি যে সব অনিয়ম-অবিচার আগেকার কালে ছিল, সে সব থেকে এখন তারা অনেকটাই মুক্ত। যেমন ধরুন, সতীদাহ প্রথা উঠে গিয়েছে, বিধবাবিবাহ চালু হয়েছে, মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে চাকরি করছে, স্বাবলম্বী হচ্ছে। কিন্তু পুরুষরা? তারা সেই দারোয়ানগিরিতে নিজেকে আটকে রেখেছে। |
কী না করতে হয় ওদের বলুন তো? কোন মেয়ে ছোট স্কার্ট পরে বেরোল, তার চরিত্র কেমন, তার পরিবারের নাম ডুবল কি না, খোঁজখবর রাখতে হয়, সুযোগ পেলে তাকে যৌন হেনস্থা করতে হয়, তার চরিত্র খারাপ বলতে হয়। শুধু কি তাই? রকে বসে আড্ডা দেবার সময় নিজের মনে গপ্পো করার ফুরসত নেই। কোন কোন মেয়ে সামনে দিয়ে গেল, তাদের প্রত্যেককে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণ করতে হল, মানে করতেই হল। এখানেই শেষ নয়। কোন মেয়ে রাত্তির করে বাড়ি ফিরল তখন তার চরিত্রে দাগ লাগাবে কে? কে এই মহৎ কার্যের দায়িত্ব তুলে নেবে? সেই পুরুষের ওপর বর্তাল দায়খানি। কোন মেয়ে রাত্রিবেলায় বার-এ গিয়ে বন্ধুর মতো ব্যবহার করল তৎক্ষণাৎ তাকে ধর্ষণ করার দায়িত্ব নিল কে? আমার-আপনার বাড়ির মা-মাসিমারা নয় নিশ্চয়ই। সেই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো পুরুষ। এবং ধর্ষণ করেই যে দায়িত্ব শেষ তা নয়। তখন ধর্ষিতার চরিত্র কত খারাপ তা প্রমাণ করতে হবে তো! কারণ পুরুষ তো তার নিজস্ব যৌন লালসা বা হিংসাবশত এ কাজ করেনি। পুরুষকে না উসকালে সে কেন এমন বাজে কাজ করবে? মেয়েটির চরিত্র খারাপ এবং সেই মেয়ে পুরুষকে প্রলোভিত করেছে বলেই পুরুষ এ কাজ করেছে। অতএব, অন্যের তাগিদে পুরুষকে প্রলোভিত হয়েও উঠতে হচ্ছে।
হাড়ভাঙা খাটুনির কি এখানেই শেষ? মোটেও না। এর পর আছে শাসন না মানার জন্য আলাদা খবরদারি। কোন বিবাহিতা পরপুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বলল, কোন কলেজ-ফিরতি মেয়ে প্রেম করে বসল অমনি তাকে নগ্ন করে ঘোরাও রে, তার মাথা ন্যাড়া করো রে, তাকে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারো রে, তার বাড়ির লোককে খুঁটিতে বেঁধে গণধোলাই দাও রে এবং বাড়ির লোকের সামনে মেয়েটিকে ধর্ষণ করো রে। উফ্ফ্! কাজের তো আর শেষ দেখি না।
তার পর ধরুন মানসম্মান রক্ষার দায়িত্ব। খাপ পঞ্চায়েত অঞ্চল হলে তো কথাই নেই। এক্সট্রা খাটনি হিসেবে বন্দুক চালানো শিখতে হবে, খুন করার মনের জোর আনতে হবে। এমনি এমনি অনুমতি ছাড়া প্রেম করে বসলে? সেই জুটিকে ধাওয়া করো, খুঁজে বের করো, তার পর খুন করো এবং বডি লুকোও। এ রকম কত ফিরিস্তি যে আছে ভাবলেও বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে।
অথচ মেয়েদের দেখুন, ফুরফুরে পরির মতো সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা, বড় স্বস্তিতে আছে। তারা মোটামুটি জানে তাদের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। রান্না করো, ঘর সামলাও, চাকরি করো এ সব তাদের জানা। এবং সব চেয়ে বড় কথা, যা তাদের ‘করা উচিত নয়’ সে সবও যদি মেয়েরা করতে চায় তা হলে কতটা লড়াই করতে হবে, কত আন্দোলনে যোগ দিতে হবে, কতটা ডিফায়ান্স দেখাতে হবে সে সবও তারা জানে। এবং কোথায় গিয়ে হাল ছাড়বে তা-ও পরিষ্কার। অন্তত জীবন সম্পর্কে এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা আছে।
কেন আছে? আছে, কারণ তাদের অন্যের জীবনে সর্বক্ষণ পুলিশগিরি করতে হয় না।
কিন্তু পুরুষ? তাদের বেচারা সব সময় মেয়েদের উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে এতটাই নিয়োজিত থাকতে হল যে নিজেদের প্রতি ঠিকঠাক নজর দিতে পারল না। তাদের সত্যিকারের পোটেনশিয়াল বাস্তবায়িত করতে পারল না। এর চেয়ে পরাধীন আর কেউ আছে? হয়তো পুলিশও কতকটা। যত ক্ষণ অপরাধ না হচ্ছে, তারা স্বাধীন। কিন্তু চোর যেই চুরি করে পালাল, অমনি পুলিশকে ছুটতে হল। চোর তো নিজের জন্য চুরি করল এবং নিজের প্রাণের তাগিদে পালাল। কিন্তু বেচারা পুলিশ? তাকে নিজের কথা ভুলে গিয়ে চোরের পেছনে ধাওয়া করতে হল।
কে বলতে পারে, পুরুষ যদি নারীর ওপর এত নজরদারি না করত, তা হলে মানবসভ্যতা আরও উন্নত হতে পারত? আরও নতুন আবিষ্কার, আরও যুগান্তকারী সৃষ্টি হতে পারত। পুরুষ নিদেনপক্ষে উদাস হয়ে আকাশের তারা দেখতে পারত কিংবা ডিপ্রেসড হয়ে ঘরের কোনায় মুখ গুঁজে থাকতে পারত। মোদ্দা কথা, সময়টা ‘নিজের’ ভাল লাগার বা ‘নিজের’ খারাপ লাগার জন্য ব্যয় করতে পারত। অন্যের জন্য নিংড়ে দিতে হত না নিজেকে।
কিন্তু আখেরে কী হল? নারীর ওপর নজরদারি করতে গিয়ে পুরুষ নিজেদের স্বাধীনতা হারাল। এবং সবচেয়ে দুঃখ কীসে জানেন, নিজেরা যে নিজেদের পরাধীন করল সেটা বুঝতেও পারল না। বরং নিজেদের ইগো বুস্ট করার জন্য এ পরাধীনতার একখানা জম্পেশ নাম দিল: পৌরুষ।
আর এখানেই মেয়েরা জিতে গেল হ্যান্ডস ডাউন। নিজেদের নিপীড়িতা পোরট্রে করে আসলে পুরুষকে পরাধীন করল তারা। তাকে বিচ্যুত করে দিল তার নিজস্ব কক্ষপথ থেকে।
এ কথা বুঝতে পুরুষের অবিশ্যি আরও দু-তিনশো জন্ম লাগবে। |