গায়ক যতই বলুন, আর শ্রোতারা যতই উচ্ছ্বসিত হইয়া শুনুন, পৃথিবী যাযাবরদের আপন করে নাই। যাঁহারা গৃহী, স্থিত, তাঁহারা এই ঠিকানাহীন জনগোষ্ঠীকে সন্দেহের চোখে দেখিয়াছেন। বাহ্যিক কারণে সন্দেহ তো বটেই যাযাবররা ছেলে চুরি করে, খুন করিতেও দ্বিধা করে না, যাযাবর রমণীরা স্খলিত চরিত্রের হইয়া থাকে এমন হাজার বিশ্বাস বহু প্রজন্ম ধরিয়া গৃহীরা বহন করিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু, এহ বাহ্য। এই ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীকে কেন ‘অপর’ বলিয়া দেখাই সমাজের দস্তুর, তাহার কারণ সম্ভবত মনস্তত্ত্বের গভীরে অনুসন্ধান করিতে হইবে। এই যাযাবর গোষ্ঠী প্রকৃত প্রস্তাবে গৃহী মানুষের প্রতিস্পর্ধী সত্তা। যে গণ্ডি, যে বন্ধনকে গৃহী ধ্রুব এবং অলঙ্ঘ্য জ্ঞান করে, যাযাবররা দেখাইয়া দেয়, সেই গণ্ডি আসলে নিতান্ত স্ব-আরোপিত। গৃহী তাহাকে অতিক্রম করিতে চাহে না, তাই পারে না। সেই গণ্ডি অতিক্রম করার, ঘর হইতে বাহির হওয়ার আকর্ষণ মানুষের রক্তে, আদিম যুগের যাযাবরবৃত্তির টান এখনও মুছিয়া যায় নাই। কিন্তু সমাজের বিবিধ সমীকরণ গৃহীকে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে। রক্ত যতই টানুক, তাহাকে প্রশ্রয় দেওয়ার উপায় তাহার আর নাই। ফলে, যাহারা পারে, তাহাদের প্রতি বিদ্বেষ অস্বাভাবিক নহে। যাযাবররা রক্তের টানে সাড়া দিয়াছে, ফলে গৃহী এক অর্থে তাহাদের নিকট পরাজিত। সেই পরাজয়ের গ্লানিকেই অবিশ্বাসে বদলাইয়া লইয়াছে সংসারী মানুষ। যেহেতু সমাজের ক্ষমতার উচ্চাসনে সংসারীরই অধিকার, ফলে যাযাবরদের ‘অপর’ হিসাবে দাগাইয়া দিয়া, তাহাদের পৃথক হওয়াকে অপরাধের তকমা দিয়া তাহাদের প্রান্তিকতম করিয়া রাখিতে সমস্যা হয় নাই।
সম্প্রতি জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দিল, এই যাযাবর জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় আনিতে হইবে। কেন, তাহার বিবিধ কারণ থাকাই স্বাভাবিক। সেই কারণগুলির পাশাপাশি, সম্ভবত অবচেতনেই, আরও একটি কারণ থাকা সম্ভব বিশ্বায়ন মানুষের যাযাবরবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়াছে। যে ভৌগোলিক গণ্ডিকে গৃহী এত দিন অলঙ্ঘ্য জ্ঞান করিয়াছিল, বিশ্বায়ন তাহাকে ভাঙিয়া দিয়াছে। এখন বিশ্বনাগরিকের সংখ্যা নেহাত নগণ্য নহে কলিকাতা হইতে ক্যালিফোর্নিয়া, দিল্লি হইতে দুবাই ঘর পাতা আছে অনেকেরই। এবং, সমাজের সাফল্যের মাপকাঠিতে তাঁহারাই সফলতম। যাঁহারা ততখানি সফল নহেন, তাঁহারাও জগৎসভায় আমন্ত্রণ পাইয়াছেন। বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বন্ধুত্বের পরিসর এখন বিশ্বময়। যাঁহাদের দিনের একটা বড় সময় এই ওয়েবসাইটগুলিতে কাটে, তাঁহাদের নিকট আর নিজের শহর বা গ্রামের ভৌগোলিক পরিসরটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নহে। তাঁহারা মানসিক ভাবে যাযাবরই বটে। গৃহী এখন গণ্ডি পার হইতে শিখিয়াছে, ফলে যাঁহারা স্বভাবতই গণ্ডি অতিক্রম করেন, তাঁহাদের প্রতি পূর্বের অবিশ্বাস, বিদ্বেষ আর নাই। গৃহী এখন যাযাবরদের অনেক নিকট হইতে বুঝিতে পারে। ফলে, সমাজের মূলধারার দরজাও যে যাযাবরদের জন্য ক্রমে খুলিয়া যাইবে, তাহা এক প্রকার স্বাভাবিকই বটে। |