শ্যামবাজারকে সাহস জোগাচ্ছে সিডনি। লন্ডন দাঁড়াচ্ছে বরাহনগরের পাশে। আর এর সবটাই হচ্ছে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট-এর সাহায্যে!
এর আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের নানা রকম ব্যবহার দেখা গিয়েছে। কখনও কখনও তা নিয়ে বিতর্কও উঠেছে। কিন্তু, কোনও গঠনমূলক কাজে এই ধরনের সাইটের ব্যবহার কী চেহারা নিতে পারে, এ বার তারই প্রতিফলন মিলল ক্যানসার সংক্রান্ত এক ‘কমিউনিটি’র মধ্যে। নাম ‘ক্যানঅ্যানসার’। ক্যানসারেরও উত্তর রয়েছে!
ক্যানসার রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের হাজারো কষ্ট, উৎকণ্ঠা একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে, অজস্র প্রশ্ন, বিভ্রান্তির সমাধান চিকিৎসকদের কাছে জেনে নিতে এই শহর থেকেই তৈরি হয়েছে ওই মঞ্চ। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশের মাটিতেও।
শুরুটা করেছিলেন এই শহরেরই এক সফ্টওয়্যার কনসালট্যান্ট। মা ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরে নিজের পরিবারের বিধ্বস্ত চেহারাটাই তাঁকে পরবর্তী সময়ে এমন একটি মঞ্চ খোলার ভাবনা জুগিয়েছে। অয়ন চৌধুরী নামে ওই যুবকের কথায়, “এক দিকে প্রিয়জনকে ওই ভাবে কষ্ট পেতে দেখছি, তার পাশাপাশি নিজেরাও বিভ্রান্ত। কী করব, কোন ডাক্তারের কাছে যাব, কোথায় কেমোথেরাপি হবে? ডাক্তারকে তো সব সময়ে বিরক্ত করা যায় না। তা হলে কাকে এই প্রশ্ন করব? শৌখিন সমবেদনার পরিবর্তে কে আমাদের ঠিক রাস্তা দেখাবেন? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই এই কমিউনিটি তৈরি করি।”
গত ১ জুলাই, চিকিৎসক দিবসে এই কমিউনিটির সূচনা হয়। ক্যানসার রোগীদের সেরে ওঠার অজস্র নজিরও এই সাইটে আপলোড করেছেন অয়ন। পাশাপাশি আছে হাতে হাত রাখার অন্য গল্পও। কেমোথেরাপি নিতে নিতে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কলকাতার এক কিশোর ক্যানসার রোগী জানিয়েছে তার হতাশার কথা। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন সুদূর সিডনির ক্যানসার আক্রান্ত প্রৌঢ়া। তাকে সাহস জুগিয়ে বলেছেন, “এই কষ্ট সাময়িক। এর পরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ঝলমলে জীবন।” এক ক্যানসার রোগীর মেয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘অস্ত্রোপচার করলে কি ক্যানসার আরও ছড়ায়?’ চটজলদি উত্তর হাজির। দেশ-বিদেশের একাধিক ক্যানসার রোগী জানিয়েছেন, এটি একেবারেই ভুল ধারণা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাও এই একই সাইটে চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন, ওই ধারণা কতটা অবৈজ্ঞানিক। ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সফ্টওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেস কোম্পানিজ’ (ন্যাসকম)-এর কর্তা সুপর্ণ মৈত্রের কথায়, “চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষকে এক করতে এই ধরনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট চালু হয়েছিল। তার পরে ক্রমশ দেখা গেল, এর বৃত্তটা অনেক বড় হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে একটা বাজারও তৈরি হয়েছে। কিছু মানুষ অসৎ উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করেছেন, তা যেমন ঠিক, তেমন অনেকে বিভিন্ন বিষয়ে জনমত তৈরির কাজেও একে ব্যবহার করছেন। এর ফলে বহু ক্ষেত্রেই গোটা বিশ্বের মানুষ যেন একটা পরিবারে সামিল হয়ে যাচ্ছেন।”
ক্যানঅ্যানসার-এর অন্যতম সদস্য, ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “রোগীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন, একই সঙ্গে সেই আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরাও। এটি খুব অভিনব। আমাদের মতো দেশে, যেখানে ক্যানসার ক্রমশ মহামারীর আকার নিচ্ছে, সেখানে এই প্রয়াস খুব উল্লেখযোগ্য।”
বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’র গায়ক সুরজিৎ ক্যানঅ্যানসার-এর সদস্য। তিনি বলেন, “আমার ঠাকুরমা ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরে গোটা পরিবার কী ভাবে ভেঙে পড়েছিল, আমি তার সাক্ষী। ওই সময়ে এক জন যথার্থ গাইড দরকার ছিল। ক্যানঅ্যানসার হয়ে উঠতে পারে সেই বন্ধু।”
কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির পাশাপাশি অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন অভিনেতা, নাট্য পরিচালক চন্দন সেন। তাঁর কথায়, “কী অসম্ভব খরচ এই রোগে, তা আমি ভুক্তভোগী বলেই জানি। তার উপরে একটি ধারণা রয়েছে কলকাতায় কিছু হয় না, বাঁচার জন্য মুম্বই ছুটতে হবে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই ঘটিবাটি বিক্রি করার অবস্থা হয়। মানুষকে সচেতন করতে একটি মাধ্যম দরকার।” চন্দনের মতে, এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট হয়ে উঠতে পারে সেই মাধ্যম। আর তাই ভুক্তভোগী হিসেবে তিনি চাইছেন এই সাইটকে কাজে লাগিয়ে তাঁর মতো ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে। |