হলদিয়ার আইকেয়ার মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন বাতিল করে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই) যে নির্দেশ দিয়েছিল, বুধবার তা খারিজ করে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। খারিজ হল তার অনুমোদন বাতিল সংক্রান্ত রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশ। রাজ্য সরকারও কলেজটির ‘এসেনশিয়াল সার্টিফিকেট’ ফিরিয়ে ঠিক করেনি বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছে আদালত।
সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে এই রায় চ্যালেঞ্জ করবে। উল্লেখ্য, হলদিয়ার ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের পরিচালন কমিটির চেয়ারম্যান সিপিএমের প্রাক্তন সাসংদ লক্ষণ শেঠ। রায় শুনে এ দিন যাঁর ‘সংযত’ প্রতিক্রিয়া, “এই কলেজ রাজ্য ও দেশের সম্পদ। আমি মুখ্যমন্ত্রীকেও সহযোগিতা করার অনুরোধ জানাব। এটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এত দিন ধরে যে টানাপোড়েন চলেছে, তাতে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যেরই ক্ষতি হয়েছে।” যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠদের একাংশের প্রতিক্রিয়া, “সরকার যে লক্ষ্মণবাবুকে হেয় করতেই কলেজ বন্ধ করতে চেয়েছিল, এখন তা পরিষ্কার হয়ে গেল।”
পাশাপাশি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছেন কলেজটির পড়ুয়ারা, যাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশেই এ বার এমবিবিএসের ফার্স্ট সেমেস্টারের পরীক্ষা দিয়েছেন। বস্তুত তাঁরা ওখানে আর পড়তে পারবেন কি না, হাইকোর্টের নির্দেশের উপরেই তা নির্ভর করছিল। হাইকোর্টের বিচারপতি গিরিশ গুপ্ত এ দিন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ওই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ওঁদের পঠনপাঠনে যাতে কোনও ব্যঘাত না-ঘটে, কলেজ-কর্তৃপক্ষকে তা সুনিশ্চিত করতে বলেছে আদালত। |
শুনে পড়ুয়ারা স্বভাবতই খুশি। যেমন গড়িয়ার সুমিতাভ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ভাবছিলাম, সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাস করতে পারব কি না। চিন্তা কাটল।” কেষ্টপুরের দেবস্মিতা চক্রবর্তীর কথায়, “এক বছর ধরে অনিশ্চয়তা চলছে। আশা করি, তা শেষ হল। আমাদের অভিভাবকেরাও নিশ্চিন্ত হলেন।” আইকেয়ার সোসাইটির সম্পাদক আশিস লাহিড়িও বলেন, “এতগুলো ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় ছিলাম। সকলেই আমাদের রাজ্যের। তাঁদের পড়াশোনা বন্ধ হবে না, এটাই স্বস্তি।” আদালত ‘এমসিআইয়ের অনুমোদনক্রমে’ কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ভর্তির কথা বলায় কলেজ-কর্তৃপক্ষ আশান্বিত। যদিও রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি, তা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। এক কর্তার কথায়, “প্রশ্নই ওঠে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো ২৫ জুলাই ছিল ভর্তির শেষ দিন।”
রাজ্যে শাসনক্ষমতায় পালাবদলের পরে, গত নভেম্বরে আইকেয়ার মেডিক্যালের অনুমোদন বাতিল করেছিল স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়। পরে এমসিআই-ও অনুমোদন রদ করে। সোসাইটি ও কলেজের পরিচালন কমিটি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেছিল, তাতে পড়ুয়াদের অভিভাবকেরাও সামিল হন। ফয়সালা কী হতে যাচ্ছে, মঙ্গলবার বিচারপতি গুপ্তের পর্যবেক্ষণেই তার একটা আঁচ মিলেছিল।
আর এ দিন রায়দানের পরে দেখা গেল, আদালত কার্যত রাজ্য সরকারকে ‘তুলোধোনা’ করেছে। কী রকম?
কলেজটির অনুমোদন বাতিল করে রাজ্য সরকার, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমসিআইয়ের জারি নির্দেশিকা খারিজ করে দিয়ে বিচারপতির মন্তব্য, বিষয়টি নিয়ে রাজ্য চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার কোন যুক্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের ‘এসেনশিয়াল সার্টিফিকেট’ প্রত্যাহার করল, সে প্রশ্ন তুলে বিচারপতি জানিয়েছেন, আইনত এটা করা যায় না। উপরন্তু অনুমোদন রদের এক্তিয়ার স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই বলেও রায়ে জানানো হয়েছে।
হাইকোর্ট আঙুল তুলেছে এমসিআইয়ের ভূমিকার দিকেও। বিচারপতির বক্তব্য: এমসিআইয়ের পেশ করা যুক্তিগুলোর আইনি ভিত্তি নেই। বরং তিন-তিন বার পরিদর্শন করে প্রতি বারই তারা কলেজের পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে, একই ভবনে দু’টো কলেজ চলার ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলেনি। ২০১১-র ৯ ডিসেম্বর এমসিআই হঠাৎ আইকেয়ারের অনুমোদন বাতিল করে। তার কিছু দিন আগে, ২৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারও আগে, ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ‘এসেনশিয়াল সার্টিফিকেট’ ফেরায় রাজ্য। “তিন পক্ষ একযোগে সম্পূর্ণ বেআইনি পদ্ধতিতে অনুমোদন বাতিল করেছে।” মন্তব্য বিচারপতির। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, এক বাড়িতে দু’টো কলেজ চালানো যাবে না এমসিআইয়ের এমন কোনও বিধি নেই। তাই এ বিষয়ে এমসিআই কোনও অভিযোগ আনতেই পারে না। |
একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসক ও মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা যে কম, তা উল্লেখ করে আদালত বলেছে, রাজ্যে যেখানে অনেক কিছুই তৈরি করা যাচ্ছে না, সেখানে তৈরি হওয়া কলেজ বন্ধ করার মতো বিলাসিতা সাজে না। ওই কলেজ থেকে ফি বছর যে একশো ডাক্তার বার হবেন, তাঁদের রাজ্যের প্রয়োজন। তাই রাজ্যের স্বার্থেই কলেজটি চালু রাখা জরুরি বলে হাইকোর্ট মনে করছে। বস্তুত মেডিক্যাল কলেজের অপ্রতুলতায় চিকিৎসকের অভাবের কথা যে সরকার নিজেই বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছে, তারাই একটি চালু মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ করতে ‘প্রয়াসী’ হওয়ায় আদালত বিস্মিত।
সরকার কী বলছে? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রায় খতিয়ে না-দেখে তাঁরা মন্তব্য করবেন না। তবে স্বাস্থ্যভবনের একটি মহলের দাবি, “পরিকাঠামো ছাড়া মেডিক্যাল কলেজ খুলে ওখানে ছেলেখেলা চলছিল। আমরা বরদাস্ত করিনি। কারণ যাঁরা ওখান থেকে ডাক্তার হয়ে বেরোবেন, তাঁরা আসলে কিছুই শিখবেন না।” এমসিআই-কর্তাদের বক্তব্যেও এর প্রতিধ্বনি। কাউন্সিলের অতিরিক্ত সচিব পি প্রসন্নরাজ বলেন, “ওদের তো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোই ছিল না! ছবিটা নিশ্চয় রাতারাতি বদলায়নি। ভর্তির সময়ও পেরিয়ে গিয়েছে।”
এমসিআই-ও কি উচ্চতর আদালতে যাবে?
সচিব বলেন, “আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে এ সপ্তাহে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।” |