প্রবন্ধ ২...
নারীর প্রতি হিংসাই একমাত্র অপরাধ, যেখানে
বিচারপ্রার্থীর পোশাক ও চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হয়
থের ধারে সদ্য ধানকাটা মাঠে পড়ে ছিল মেয়েটি। ভোর। শৌচাগারহীন গরিব বাড়ির মেয়েরা যেমন বার হয়, তেমনই সেও বেরিয়েছিল। পথচলতি ইট বোঝাই ট্রাকটর মালিকের কাছে খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন যখন ছুটে যায়, তখন সে অচৈতন্য, মুখে গাঁজলা উঠছে, গলায় দড়ির দাগ, অর্ধ-আচ্ছাদিত দেহ। স্থানীয় ডিসপেনসারি বাড়ির লোকের অনুরোধ সত্ত্বেও সাপে-কাটা-কেস বলে তাকে পাঠায় রাজধানীর হাসপাতালে। ধর্ষণের অভিযোগ সংবলিত এফ আই আর নিতে রাজি হয় না স্থানীয় থানা। বলে, মেয়ে তো অজ্ঞান। আগে জ্ঞান ফিরুক, তবে তো তদন্ত হবে, তখন না এফ আই আর! আড়াই মাসে তার অচৈতন্য শরীর এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে ঘুরেছে দিনমজুর বাবা, ভাই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে প্রবল জনমতের চাপে তদন্ত হাতে নেয় ক্রাইম ব্রাঞ্চ। সত্য উদ্ঘাটন হওয়া আই সি ইউ-এর ধবধবে বিছানায় শুয়ে থাকবে আর অক্সিজেনের অভাবে মৃতপ্রায় তার মস্তিষ্ককে জাগানোর জন্য চলবে সংগীত-থেরাপি মেয়েটি কখনও ভেবেছিল কি?
সম্পন্ন গ্রামের মাত্র তিনটি দলিত ঘরের একটিতে তাদের বাস ছিল। ভাল গাইত মেয়েটি। জলসায় যেত। বছর কয়েক আগে একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির সাক্ষী ছিল সে। অভিযুক্তরা কয়েক মাস ধরেই ধমকাচ্ছিল, কেস কোর্টে ওঠার আগে থেকে। সাক্ষী হিসেবে কোনও সুরক্ষা তার প্রাপ্য ছিল না কি?
হাসপাতালের আই সি ইউ থেকে ফেরার পথে পুলিশের সদর দফতরে উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছিল, নারীর বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনাকে গড় অপরাধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবার কোনও ইচ্ছা বা সঙ্গতি পুলিশের নেই। তা ছাড়া, যে মেয়ে অমন গায়, জলসায় যায়, সে কি আর ‘তেমন দলিত’? রাজ্য মহিলা কমিশন তাদের রিপোর্টে মেয়েটির পরিবারকেই একহাত নেয় কেন তারা সময়ে এফ আই আর করেনি? কেনই বা হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে চিকিৎসা করাচ্ছিল মেয়েটির? আই সি ইউ-এর বাইরের মেঝেতে বসে থাকা মেয়ের অসহায় বিভ্রান্ত বাপের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বেদনা, ক্ষোভ, দারিদ্রের বাস্তবকে বোঝার চেষ্টা করেনি কোনও প্রতিষ্ঠান। পাঁচ মাস কোমায় থেকে মুক্তি পেয়ে যায় মেয়েটি। ভাগ্যিস তার মস্তিষ্ক মরে ছিল আগেই! তত দিনে খবরকাগজের প্রথম পাতা থেকে সরে চলে গেছে শেষ পাতার এক চিলতে কলমে। নির্বাচন যে শেষ! ফলাফলও ঘোষিত!
আর্তনাদ। শিল্পী এডভার্ড ম্যুন্খ ১৮৯৫ সালে এঁকেছিলেন ‘দ্য স্ক্রিম’ সিরিজের এই ছবিটি। জাতি-লিঙ্গ
চিহ্নহীন মানুষটি অসহনীয় আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বের কাছে। গত মে মাসে ছবিটি
বিক্রি হল ৬০০ কোটি টাকায়, যা নিলামে বিক্রীত ছবির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যা
না কি নির্বিচার নারী নিগ্রহ— কোন বীভৎসতা ঘা দিয়ে যায় একবিংশের দর্শককে?
ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলার প্রত্যন্ত আমরাপাড়া গ্রামে এক ধর্ষিতা আদিবাসী মেয়ের এফ আই আর পুলিশ কেন নেবে না, এই নিয়ে বার বার থানা, ডি এস পি, শেষে জেলা শাসকের কাছে আবেদন করছিলেন সিস্টার ভালসা জন। গত কুড়ি বছর ধরে কয়লাখনির জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করেছেন। কোম্পানির কাছ থেকে চাকরি ও ঠিকেদারি জুটিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। ধর্ষিতা মেয়েটি তাঁর অনুগত ছিল।
সতেরো দিনেও মেয়েটির বা অভিযুক্ত গণধর্ষণকারীদের কোনও ডাক্তারি পরীক্ষা হয়নি। পুলিশ নিজেই সালিশি করে অভিযুক্তদের বলে মেয়ের বাপকে টাকাপয়সা দাও, আমাদেরও। তা হলে আর কেস হবে না। এই অসম্মানজনক শর্ত মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি, তার বাবা এবং সিস্টার জন। শেষে, জেলাশাসক এবং এস পি যে দিন এফ আই আর নিতে রাজি হন, তার আগের দিন মধ্যরাতে ষাট/সত্তর জনের এক সশস্ত্র উন্মত্ত জনতা নিরস্ত্র এক মহিলাকে পিটিয়ে খুন করে অপরাধ? ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা! দু’দশকের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে একক মহিলা হয়ে গ্রামের মানুষকে পাশে পাওয়ার ক্ষমতা! উন্মত্ত জনতা সিস্টারকে ঘিরে ফেলেছে, এই খবর পেয়েও তিন কিলোমিটার দূরের থানা থেকে রাতে পুলিশ আসতে রাজি হয়নি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে, ভালসা জনের মৃত্যুর পরের দিন সকালে প্রথমে গণধর্ষণ ও পরে গণহত্যার এফ আই আর নেওয়া হল। এফ আই আর নেওয়ার থেকে কঠিনতর কিছু আছে বলে মনে হয় না অপরাধ যখন নারীর বিরুদ্ধে।
জাতীয় মহিলা কমিশনের তদন্তকারী দলকে ইউনিফর্ম পরা উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার বলেন ‘এফ আই আর তো সাব দেশ মে কহিঁ নহী লিয়া জাতা হ্যায়! হমনে ভি নহী লিয়া!’ ব্যাখ্যা করে বলেন। এই সব আদিবাসী মেয়েগুলি অতি শিথিল চরিত্রের। পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা দরে না পোষালে ধর্ষণের অভিযোগ আনে। তখন মেয়েটির জন্য ক্ষতিপূরণের টাকার বন্দোবস্ত করতেই পুলিশকে সালিশি করতে হয়। অন্যান্য সুপারিশের সঙ্গে অফিসারটির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে চার্জশিট ও ভবিষ্যতে সমস্ত পদোন্নতি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ দিয়েছিল কমিশন। এফ আই আর নিতে দেরি করার জন্য অধস্তন এক পুলিশকর্মী সাসপেন্ড হয়েছিল। কিন্তু সিস্টার জনের হত্যার দায়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করার দায় কোনও পদস্থ অফিসারের উপর বর্তায়নি।
কলকাতায় পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে আক্রান্ত মহিলা পেয়েছিলেন কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীর অশালীন মন্তব্য। পরে নগর-নেতার কণ্ঠে শোনা যায় নারীর আচরণ কী ভাবে ধর্ষকদের আহ্বান জানাতে পারে, তার ব্যাখ্যা। সংবাদপত্র পড়ে জাতীয় মহিলা কমিশন জেনেছিল, ধর্ষিতা মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষা পিছিয়ে যায় কয়েক দিন, যেহেতু কোর্টের আদেশ পাওয়া যায়নি। অথচ আইনে কোথাও নেই যে, ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য কোর্টের আদেশ লাগে। তদন্তকারী দলটি পরে জানতে পারল, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এই ‘রীতি’ না মানলেও কলকাতা পুলিশে এখনও চলে এই অলিখিত আইন। কেন এই ‘রীতি’, যার কোনও আইনি প্রেক্ষাপট নেই? অভিযুক্তের তরফ থেকে যাতে কোনও পক্ষপাতের অভিযোগ না আসে, ডাক্তার যাতে পরীক্ষা করার আগে কোনও আপত্তি না করেন, সেই জন্যই কলকাতা পুলিশ আবহমান কাল ধরে কোর্টের আদেশ চেয়ে আসছে।
তার মানে, পাছে অভিযুক্তের মনে ক্ষোভ না জন্মায় এবং পাছে ডাক্তার অস্বস্তি বোধ না করেন, তার জন্য ধর্ষিতা মহিলাকে অপেক্ষা করতে হবে কোর্টের আদেশের। তাতে যদি নষ্ট হয় সাক্ষ্যপ্রমাণ, যা অভিযুক্তের শাস্তি প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ, পুলিশের কোনও মাথাব্যথা থাকবে না।
জাতীয় পুলিশ অ্যাকাডেমি’তে সম্প্রতি পুলিশের দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আলোচনায় এই প্রশ্নটি পদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের কাছে রেখেছিলাম মহোদয়গণ, ভেবে দেখেছেন কি, নারীর প্রতি হিংসাই একমাত্র অপরাধ, যার অভিযোগ দায়ের করতে গেলে নারীর পোশাক, চরিত্র, মতিগতি, ঘোরাফেরা এবং অভিযুক্তের মনের অবস্থা, তার কামুকতা, পৌরুষ ইত্যাদির বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। চুরিডাকাতি, খুনখারাপি, লুটপাটের ঘটনায় নয়! আক্রান্ত নারী যে কেবল নেতা, চলচ্চিত্রকুশলী, বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছ থেকে বিনামূল্যে সদুপদেশ পান, কী ভাবে শরীর ঢাকলে তিনি ধর্ষক বা শ্লীলতাহারকদের আহ্বান থেকে বিরত থাকতে পারবেন, নারীর অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধানের নির্দেশে গঠিত সংগঠন ও পুরুষের লাম্পট্য, লালসা, নারীর পোশাকনীতি এই সবের উল্লেখ করে পুরুষ অভিযুক্তের প্রতি সস্নেহ প্রশ্রয় এবং নারীর উপরই আক্রমণের দায় চাপিয়ে তৃপ্ত বোধ করেন।
উপায় তা হলে কী? মুম্বই থেকে গুয়াহাটি, পাকুড় থেকে পার্ক স্ট্রিট, বাঁকুড়া থেকে জোধপুর নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসা ও আক্রমণ, তৎপরবর্তী আক্রান্তের চরিত্রহনন পোশাক/আচরণবিধি প্রণয়ন দেখেশুনে ক্ষুব্ধ, অপমানিত আমরা মোমবাতি জ্বালব, মৌনমিছিল করব, সংবাদপত্রে বয়ান দেব, তার পর যথাসময়ে সব ভুলে কৃতজ্ঞতায় পুরস্কৃত করব হিংসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থক ওই সব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে!
আসলে, শিক্ষিত সমাজেরও আইন প্রণয়ন নিয়ে যতটা তাত্ত্বিক আগ্রহ, অপরাধীর মনঃস্থিতি বিশ্লেষণে যে পারঙ্গমতা, আইনের অনুপালন নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও মনোযোগ নেই। আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের সংগঠিত চক্রের হাতে অজাত কন্যার নিধনকে আমরা অপরাধ বলে মনে করি না, বরং পরিবারের পুত্রেচ্ছাকে সহানুভূতি জানাই। ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করি অথচ ধর্ষিতাকে স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকায় বঞ্চিত দেখলে আমাদের চিত্তবিকার হয় না। পুলিশ ও ডাক্তারের হৃদয় পরিবর্তন হোক এমন বাসনা মনে রাখি, অথচ জনতার অর্থে প্রতিপালিত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা দাবি করি না। সেই জন্য, আদিবাসী রমণীর প্রতি অশালীন উক্তি করেও পদস্থ পুলিশ আরও উন্নীত হন। আক্রান্ত মহিলাকে পোশাকবিধির শিক্ষা দিয়ে হিংসাকে সমর্থন জানান যে-শিল্পী, তাঁর রঙিন ছবি ছাপা হয়, নেওয়া হয় ‘বাইট’। নারীর প্রতি হিংসাকে ইন্ধন জুগিয়েও নেতা বৃহত্তর, উন্নততর নেতায় পরিণত হন, আর মোমবাতির পায়ের কাছে জমা হয় আমাদের নিরস্ত্র অশ্রুবারি।
ভারতের সংবিধান নারীর জীবন ও জীবিকার মৌলিক অধিকারকে স্বীকার করে হিংসা ও আক্রমণমুক্ত জীবনে নারীর অধিকার জন্মগত। ভারতীয় দণ্ডসংহিতা নারীর বিরুদ্ধে হিংসাকে দণ্ডনীয় বলে চিহ্নিত করেছে। মূল অভিযুক্ত যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য, নারীর প্রতি হিংসাকে যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করেন নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করে অথবা কতর্ব্যের সীমা উল্লঙ্ঘন করে তাঁদেরও প্রাপ্য অপরাধীর শাস্তি ও জনমানস থেকে নির্বাসন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.