নেতাদের কথায় নির্যাতিত মেয়েদের ক্ষোভ প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় নির্যাতনকারী
যুবকদের
নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য। কারণ পার্টির ব্যাজ-সাঁটা পুরুষতন্ত্র আমাদের রাজনীতিকে চালায়। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
তৃণমূল বিধায়ক চিরঞ্জিতের সাফাইয়ে কোনও ভুল নেই। ভুল তাঁর রাজনীতিতে। সত্যিই তো, আর পাঁচ জন বাবা কিংবা দাদা যে কথা বলবেন, বারাসতে নিগ্রহের শিকার কিশোরীর সম্পর্কে সেই কথাই বলেছেন চিরঞ্জিৎ। ছোট স্কার্ট পরে রাস্তায় বেরিয়েছে মেয়েরা আর ছেলেরা তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, এমন রোমহর্ষক চিত্রনাট্যে বহু বার ভিলেন পিটিয়ে নায়িকা উদ্ধার করেছেন তিনি। প্রেমিকের ভূমিকায়, কিংবা দাদার ভূমিকায়। বাবা-দাদার সংলাপের সঙ্গে তাঁর সংলাপ যে মিলে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী। এই সব বুদ্ধিমান বাবা-দাদারাই মেয়েদের ইস্কুল শেষ না-হতেই বিয়ে দিয়ে দেন। নইলে টিউশন পড়তে যাবেই, তা হলেই ফিরবে সন্ধে করে, খাটো ঝুলের পোশাকও পরতে পারে কেউ কেউ কী দরকার ঝামেলায়?
বারাসতের তরুণী অবশ্য সে দিন পরেছিল সালোয়ার-কামিজ। কিন্তু যাঁরা চিরঞ্জিৎকে ভোট দেন, সেই বাবা-দাদারা যৌন হয়রানি ব্যাপারটা কী চোখে দেখেন, তা জানেন চিরঞ্জিৎ। এবং তাঁর দলও। বারাসতের ঘটনায় মিডিয়া যতই চেঁচামেচি জুড়ে দিক, কানে যা তালা ধরাচ্ছে তা হল মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা। অন্য নেতারা যেটুকু বলেছেন তা-ও নেহাত ঠুনকো প্রতিবাদ ‘আহা, অন্য পোশাক পরলে কি আর রেপ হয় না? সব পোশাকেই হয়।’ যে কোনও মেয়ে ধর্ষণ-হয়রানির শিকার হতে পারে, এটা মনে করিয়ে দেওয়াই কি নেতা-মন্ত্রীদের কাজ?
না কি, যৌন হয়রানির সঙ্গে পুলিশের অকর্মণ্যতার, মস্তানদের দাপটের, মদের ভাটির রমরমা সম্পর্কের দিকে আঙুল তোলা দরকার ছিল? যে রাজনীতি সে সাহস দেখাতে পারত, তা-ই হত পরিবর্তনের রাজনীতি। ধানতলা-বানতলা, সুতি-নন্দীগ্রাম থেকে ১৮০ ডিগ্রি দূরত্বের রাজনীতি।
কিন্তু তা হয়নি। তৃণমূলের বিধায়ক রামায়ণের যুগ থেকে আজকের চলচ্চিত্রে মেয়েদের যৌন-হয়রানির ধারাবাহিকতা মনে করিয়ে দিয়ে আসলে যা বলেছেন, তা হল ‘এমন তো কতই হয়।’ এত রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে আনা পরিবর্তন, যাতে মেয়েদের দুর্বিষহ যন্ত্রণাদগ্ধ লড়াই বড় কম নেই, তা আসলে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে মেয়েদের দাঁড় করিয়ে দিল সেই এক জায়গায়। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে মদন মিত্রের মন্তব্য, আর বারাসতে চিরঞ্জিতের মন্তব্য, এই দুই সংলাপ গোটা বাংলার মেয়েদের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছে। |
কাদের জয়? মেয়েদের কথা তাঁদের রাজনৈতিক দলে শোনা হয় না। |
রাস্তার মাতাল ‘ভিলেন’ আমাদের রাজ্যে মেয়েদের ছোট সমস্যা। তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যাদের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে বসে রয়েছে পুরুষতন্ত্র। মেয়েদের হয়রানির প্রতিকার করতে গিয়ে মেয়েদের ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করেই তো তা ক্ষান্ত হয় না। জনজীবনে মেয়েদের স্থান কোথায়, রাজনীতিতেই বা মেয়েদের কতখানি জায়গা পাওয়া দরকার, কেমন করে সেই জায়গা তৈরি হবে, তার সবটাই পার্টির ব্যাজ-সাঁটা পুরুষতন্ত্র স্থির করে। ক্ষমতার বিলিব্যবস্থা যত নীরবে হয়, আড়ালে হয়, তত কোণঠাসা হয় মেয়েরা। খোলাখুলি হলে, নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নানা স্তরের নেতা-নেত্রী স্থির হলে, মেয়েদের কথা বলার, লড়াই করার অন্তত একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু যখন কোনও এক অলিখিত নিয়মে সব স্থির হয়ে যায়, তখন মেয়েদের ক্ষমতার আসনে না রাখাটাই ‘স্বাভাবিক’ মনে হয় নেতাদের। যেমন মেয়েদের সন্ধ্যার পর ঘরে থাকা ‘স্বাভাবিক’।
বামপন্থীরা যে তাদের সংগঠনে মেয়েদের কখনও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি, সে অভিযোগ বার বার উঠেছে। দলের নেতৃত্বে মহিলাদের সামান্য উপস্থিতির প্রতিবাদে বৃন্দা কারাত কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের চেহারা কী? উনিশটি জেলার মধ্যে মাত্র একটিতে দলের জেলা সভাপতি মহিলা মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র। ব্লক সভাপতিদের মধ্যেও মেয়েদের সংখ্যা নগণ্য। তৃণমূলের জেলা সংগঠনে মেয়েরা খুব চোখে-পড়ার মতো জায়গায় নেই, যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ নেতাদের ছায়ামাত্র। এর অর্থ কী?
এর মানে এই যে, সংবিধান সংশোধন করে, সরকারি নির্দেশ বের করে, মেয়েদের জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতে, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদে, এক-তৃতীয়াংশ থেকে মেয়েদের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে অর্ধেকে, কিন্তু দল তাকে ক্ষমতার আসনে বসাতে নারাজ। তার প্রাপ্ত ভোটও তাকে দলে কথা বলার অধিকার দিচ্ছে না। দলীয় নেতৃত্বের ছায়ামাত্র হয়ে সে থেকে যাচ্ছে। সি পি এম যেমন অতি কদাচিৎ লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটিতে কোনও মহিলাকে বাস্তবিক ক্ষমতার আসন দিয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেসেও তেমনই এলেবেলে রয়ে গিয়েছেন মহিলা কর্মীরা। এমন করে ক্ষমতা দেবার ভান করে ছিনিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত পুরুষতন্ত্র।
কলকাতার ‘সচেতনা’ সংস্থা ২০০৮-০৯ সালে হুগলিতে একটি সমীক্ষা করেছিল, পঞ্চায়েতে ও রাজনীতিতে মহিলাদের ভূমিকার উপর। প্রায় সাড়ে চারশো মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, যাঁদের প্রায় অর্ধেক মহিলা। আলোচনায় মেয়েরা বলেছেন, পঞ্চায়েতে মেয়েদের জায়গা দিতে হচ্ছে, বাড়িতেও মেয়েদের কাজ ভাগ করে নিতে হচ্ছে। বিশেষ করে খাবার বেড়ে খেতে দিচ্ছে পুরুষরা, এতে তাদের প্রাধান্যে রীতিমত ধাক্কা লাগছে। ফলে পার্টির মধ্যে মেয়েদের আধিপত্যের সম্ভাবনা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে পুরুষরা। ২০১২ সালে বোঝা যাচ্ছে, সেই গতি অপ্রতিহত। মেয়েরা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরের বৃত্তে ঘুরে যাচ্ছে। তাদের কথা যে তাদের দলের মধ্যে শোনা হচ্ছে না, সেই জন্য তাদের দলের প্রতিনিধির বক্তব্য নির্যাতিত কিশোরীর ক্ষোভের প্রকাশ নয়, নির্যাতনকারী যুবকের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের প্রকাশ।
অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার মহিলা কংগ্রেসেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। রাজীব গাঁধী তাঁকে রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী করার পর থেকে তাঁর দ্রুত উত্থান। নিজেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বের দাবিদার করার জন্যই ‘মহিলা নেত্রী’ পরিচয় থেকে বরাবর দূরে থেকেছেন মমতা। গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দলের মহিলা প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে বলেছিলেন, নিজেকে তিনি ‘মহিলা প্রার্থী’ মনে করেন না। এ তাঁর স্বেচ্ছা-নির্বাচন হতে পারে, আবার এটা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতাও হতে পারে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্ষমতায় থাকার বাধ্যবাধকতা। নইলে বাঙুরের সুপারকে শোকজ করতে যাঁর এক ঘন্টাও লাগে না, বারাসতের পুলিশকর্তার জবাবদিহি তিনি এক বছরেও কেন তলব করলেন না?
কেন মুখ্যমন্ত্রী আগ্রহী নন মদের ভাটি ভাঙতে? ঘরে-বাইরে মেয়েদের উপর নির্যাতনের সঙ্গে মদের ভাটির সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। যত দুষ্কৃতী মদের ভাটির চার পাশেই ঘোরে। তবু মমতার জমানায় রাজ্যে বেআইনি মদের ভাটি কমানোর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যে লুম্পেন শ্রেণি ভাটিকে ঘিরে চক্কর কাটে, তারা যে কোনও পার্টির ঠ্যাঙাড়ে-লেঠেল। তারাই হার্মাদ, তারাই ভৈরব। সন্ধ্যার পর রাস্তায় কিশোরী-যুবতীদের উত্ত্যক্ত করার সময়ে তারাই ‘রাবণ’। তাই তৃণমূল বিধায়ক স্বচ্ছন্দে মিডিয়ার কাছে বলেছেন, এরা ছিল, থাকবে। দিদিকে বাঁচাতে ভাই খুন হলেও, মেয়েকে বাঁচাতে বাপ আধমরা হলেও, এদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না।
ভরসা কেবল এইটুকু যে, সি পি এম নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে মেয়েদের ধর্ষণ যেমন রাজনীতির জমি দখলের স্ট্র্যাটেজিতে পরিণত করেছিল, তৃণমূল শাসনে এখনও তার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। যদি সেটুকু আশ্বাস বেঁচে থাকে আর চার বছর, সে-ও মন্দের ভাল।
টেনশন কেবল একটা। চিরঞ্জিতের ঘনিষ্ঠ বাবা-দাদাদের কেউ না প্রশ্ন করে বসে, ‘তাপসী মালিক সে দিন কী পরে ভোর রাতে বেরিয়েছিল?’ |