ফের বন্ধ চা বাগানে অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগ উঠল। এবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১টি শিশু সহ ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ডুয়ার্সের মালবাজারের কুমলাই চা বাগানের ঘটনা। জ্বর, নানা অপুষ্টিজনিত রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে চা বাগানের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে ৩০ জনকে। কুমলাই চা বাগান হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার সকালের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাগুলি ঘটেছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যাচ্ছে, সোমবার বিকেলে সুমিতা ভোক্তা (২৫) নামে এক চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ওই রাতেই সনিয়া ওঁরা (৩) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। পরে মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালেই রীতা টোপ্পো (৫৩) নামে আরেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক আশিস দাস বলেন, “সুমিতা দেবী মাস দুয়েক আগে সন্তান প্রসব করেন। তখন থেকেই রক্তাল্পতায় ভুগছিলেন। সনিয়া ওঁরাও নামে শিশুটি ও রীতা টোপ্পোর জ্বর হয়েছিল। তা ম্যালেরিয়া কি না সেটা স্পষ্ট নয়। এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, তিন জনের শরীরেই চরম অপুষ্টির ছাপ ছিল।” শ্রমিক-মালিক বিরোধের জেরে প্রায় এক মাস ধরে কুমলাই চা বাগান বন্ধ। ম্যানেজার বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। জুলাই মাসে ৪টি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকা হলেও তা সেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছে।
|
একনজরে কয়েকটি বন্ধ চা বাগানে মৃত্যুর পরিসংখ্যান |
• ২০০২ সালে বীরপাড়া থানার রামঝোরা চা বাগানের মালিক বাগান ছেড়ে যান। ৮ বছর বন্ধ ছিল বাগানটি। বন্ধ থাকাকালীন ১৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭-এ রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী শ্রমিকদের অনটন দেখে সে দিন উপোস করে কাটান। টনক নড়ে সরকারের। ২০১০ অগস্টে বাগান চালু হয়েছে। |
• বানারহাটের কাঁঠালগুড়ি বাগান ২০০২ সালে বন্ধ হয়। ১১০০ শ্রমিক। শ্রমিক ও পরিবার মিলিয়ে মোট ৫২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে । সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে হাইকোর্টের নির্দেশে সরকারের টনক নড়ে। ১৫ দিন কাজ ও মাসিক ভাতা, অন্ত্যোদয় যোজনার চাল দেওয়া হয়। এখন অবশ্য বাগান খোলা। |
• ২০০২ সালে ঢেকলাপাড়া বাগান বন্ধ হয়। ৬০৪ জন শ্রমিক। ইতিমধ্যে শ্রমিক পরিবারের ১২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪০ জন বিনাচিকিৎসায় মারা গিয়েছেন। নিয়মিত ভাতা সহ সস্তায় পরিবার পিছু ৩৫ কেজি চাল এবং গম দিচ্ছে রাজ্য সরকার। ২০০ জনকে সহায় প্রকল্পের রান্না করা খাবারও দেওয়া হচ্ছে। এখনও বন্ধ। |
|
এখন বাগানের হাসপাতালে ওষুধ ফুরিয়ে গিয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্সে পেট্রোল নেই। হাসাপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন। আর পাঁচজন শ্রমিক-কর্মী যেমন বিনা বেতনে বসে রয়েছেন, তেমনই দুরবস্থা আশিসবাবুর। তিনি বলেন, “মাইনে পাচ্ছি না। ওষুধ-পথ্য নেই। ঘরে-বাইরে সমস্যা। তার উপরে বাগানের ঘরে-ঘরে অপুষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে। ৩০ শয্যার হাসপাতাল ভর্তি হয়ে গিয়েছে। কী যে হবে জানি না।” কুমলাই বাগানে মৃত্যুর খবর পৌঁছেছে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর কাছেও। শ্রমমন্ত্রী বলেছেন, “ওই বাগানে যাতে অতি সত্ত্বর খাবার-ওষুধ পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশদে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।” প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মালবাজারের মহকুমাশাসক নারায়ণ বিশ্বাস ফের ৩০ আগষ্ট ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডেকেছেন। মহকুমাশাসক এদিন বাগান পরিদর্শন করেছেন। তিনি চা শ্রমিকদের সবরকম সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। তাঁর বক্তব্য, “যতদূর শুনলাম অজানা জ্বর ছড়াচ্ছে। যাই হোক, প্রয়োজনে রোগীদের মালবাজার মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।’’ ওষুধ-পথ্যের সঙ্কটের কথা শুনেছেন মালবাজার ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক দীপকরঞ্জন দাসও। তিনি দ্রুত ওষুধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও কুমলাই চা বাগানের আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নেতা অমরদান বাক্সলারা ক্ষুব্ধ। তাঁর অভিযোগ, “মাসখানেক ধরে পেট ভরে বাগানের কেউ খেতে পাচ্ছেন না। রাজ্য সরকার কী করছে? যতদিন না বাগানো খোলে ততদিন কেন চাল-ডাল-আনাজ সরকার সরবরাহ করবে না? তা হলে কীসের পরিবর্তন?” মালবাজারের সিপিএম জোনাল সম্পাদক তথা সিটুর জেলা নেতা চানু দে বলেন, “বাগানের শ্রমিকদের প্রতিও সরকারের দায় বর্তায়। ম্যানেজার চলে যাওয়ার সময় থেকে প্রশাসন খাবার ব্যবস্থা করতে পারলে এমন অভিযোগ উঠত না।” কুমলাই চা বাগানে অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে হাসপাতালে ভর্তি হলেও চিকিৎসার অভাবে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সমাজকর্মী অনুরাধা তালোয়ার। অনুরাধা দেবী বলেন, “বাগান বন্ধের পর মানুষের মৃত্যু হবে। পরে সরকার রেশন পাঠাবে। আগেও এমন হত। এখনও তেমনই চলবে, তা হতে পারে না। ৬ অগস্ট বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে দেখার করার পরে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করব।”
|