এ এক অন্য ‘ঠান্ডা-যুদ্ধ’! আমেরিকা বনাম চিন।
যুদ্ধের আবহ তৈরি করে দিয়েছেন ষোলো বছরের এক চিনা কিশোরী। সাঁতারে তাঁর বিশ্বরেকর্ড গড়ার পিছনে ডোপিং রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে মার্কিন শিবিরের একাংশ। ওই কিশোরী একটা পর্বে পয়লা নম্বর পুরুষ সাঁতারুর চেয়েও দ্রুত সাঁতার কেটেছেন এবং সেটাই ‘সন্দেহ’ আরও বাড়িয়েছে। সুতরাং প্রশ্নটা শুধু ডোপিংয়ের মধ্যে আটকে না থেকে পুরুষ বনাম নারীর লড়াইয়ের বৃত্তেও পৌঁছেছে। এবং বিতর্কটা আরও বৃহত্তর যুদ্ধের আকার নিচ্ছে। সেটা আমেরিকা বনাম চিনের ‘যুদ্ধ’। অলিম্পিকের বাইরের যুদ্ধ। আমেরিকা যখন চিনের য়ি শিওয়েনের দিকে আঙুল তুলছে, জবাবে চিনের মুখে উঠে এসেছে আমেরিকার এক নম্বর অলিম্পিয়ান মাইকেল ফেল্পসের নাম!
অতীতে ঠান্ডা যুদ্ধের দিনগুলোয় অলিম্পিক মানে ছিল আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের পদক জয়ের লড়াই। সোভিয়েত ভাঙার পরে সেই রেষারেষিটা দাঁড়িয়েছে চিন বনাম আমেরিকার। আটলান্টা (১৯৯৬), সিডনি (২০০০), আথেন্স (২০০৪) অলিম্পিকে সোনা এবং মোট পদক সংখ্যায় এক নম্বর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু গত বার বেজিংয়ে মোট পদক জয়ে মার্কিনরা আধিপত্য বজায় রাখলেও সোনা জয়ে চিনারা উঠে এসেছিলেন এক নম্বর। এ বারও প্রথম চার দিনে চিনারা এগিয়ে। মার্কিনদের গর্বে ঘা দিয়ে সাঁতারের পুলেও তাঁরা তোলপাড় জুড়ে দিয়েছেন। কিশোরী য়ি শিওয়েন তার মধ্যে অন্যতম।
৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে শনিবারই সোনা জিতেছিলেন শিওয়েন। তাঁর সময় ছিল, ৪ মিনিট ২৮.৪৩ সেকেন্ড। তাঁর নিজের ব্যক্তিগত রেকর্ডের চেয়ে ৫ সেকেন্ড কম। বিশ্বরেকর্ডের চেয়ে এক সেকেন্ড কম। অর্থাৎ নতুন রেকর্ড গড়েছেন য়ি। তাঁর এই সাফল্য নিয়েই বেধেছে বিতর্ক। সন্দেহের আঙুল তুলে বলা হচ্ছে, য়ি ডোপিং করেছেন কি না পরীক্ষা করে দেখা হোক। কেননা, য়ি শুধু বিশ্বরেকর্ডই ভাঙেননি। মেডলি ইভেন্টে ফ্রি-স্টাইলের শেষ ৫০ মিটার তিনি সাঁতরেছেন ২৮.৯৩ সেকেন্ডে। কিছুক্ষণ আগেই ছেলেদের ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন মার্কিন সাঁতারু রায়ান লখটে। শেষ ৫০ মিটার তিনি সময় নিয়েছেন ২৯.১ সেকেন্ড। বিতর্কের মূল সূত্রটি ওখানেই। লখটে-র চেয়ে কী করে ভাল সময় করতে পারেন ১৬ বছরের একটি মেয়ে? এই জল্পনার মধ্যেই সোমবার আবার জলে নেমেছেন য়ি। ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলির সেমিফাইনালে ২ মিনিট ৮.৩৯ সেকেন্ড সময় করে নতুন অলিম্পিক রেকর্ড করেছেন তিনি। বিতর্কের চাকা অতএব তরতর করে গড়াতে শুরু করেছে। |
পদক হাতে পোডিয়ামে শিওয়েন। ছবি: রয়টার্স |
বেজিং-সাংহাই-হংকংয়ে ফেসবুক-টুইটারে ‘সার্চ’ দিলে এখন একটাই নাম য়ি শিওয়েন। সেখানে চিনাদের তোপের মুখে আমেরিকা। চিনাদের ‘টুইটার’, জনপ্রিয়তম মাইক্রোব্লগিং সাইট ‘সিনা ওয়েইবো’তে ১০ লক্ষের বেশি প্রতিবাদী মন্তব্য আছড়ে পড়েছে। এমনিতে চিনা নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ক্রুদ্ধ। কিন্তু আপাতত জাতীয়তাবাদ তাঁদের এক করে দিয়েছে। এক ব্লগার লিখেছেন, “এটাই চিনাদের সাফল্যের প্রতি পশ্চিমি মিডিয়ার আসল মনোভাব। আঙুরফল টক। শুধু কি পশ্চিমি দেশগুলোই সোনা জিতবে?”
শিওয়েনকে নিয়ে বিতর্কটার সূত্রপাত করেছেন সাঁতার-কোচদের আন্তর্জাতিক সংস্থার কার্যনির্বাহী প্রধান, মার্কিন কোচ জন লিওনার্ড। সোমবারই শিওয়েনের রেকর্ড সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে লিওনার্ড বলেন, “অবিশ্বাস্য! বিচলিত করার মতো ঘটনা।” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ডোপিং ছাড়া এমন সাফল্য আসতে পারে না। এই কথা থেকেই তোলপাড়। চিনের ডোপিং-রোধী সংস্থার প্রধান জিয়াং ঝিৎসুর পাল্টা, “ফেল্পস বেজিংয়ে ৮টা সোনা জেতার পরে কিছু বলিনি কিন্তু!” চিনা অলিম্পিক দলের প্রাক্তন ডাক্তার চেন জানঘাও-এরও প্রশ্ন, “ফেল্পস ৭টি বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছে। ও কি স্বাভাবিক?”
মার্কিন অলিম্পিক কমিটি আলাদা করে লিওনার্ডের পাশে দাঁড়ায়নি। তাঁদের মুখপাত্র ও বিবৃতি দিয়ে বলেন, “চিনাদের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ করতে চাই।” মঙ্গলবার চিনা কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে মার্কিন কর্তারা বলছেন, “ওই লিওনার্ড ভদ্রলোক আমাদের কেউ নন”। তবু বিতর্ক কমছে না। কারণ পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম এই সুযোগে চিনাদের ‘ডোপিং ঐতিহ্য’ নিয়ে নানা কথা বলছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমেও চিনাদের খোঁচা দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ১৯৯৪ সালে রোমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মেয়েদের ১৬টি খেতাবের ১২টিই জেতেন চিনারা। এক মাস পরে সাত জন চিনা চ্যাম্পিয়ন ডোপ-পরীক্ষায় ধরা পড়েন। অস্ট্রেলিয়ার পারথে, পরের বিশ্বমিটেও চিনাদের গায়ে ডোপের কালি পড়েছিল। চিনা জিমন্যাস্টিক দলের এক প্রাক্তন ডাক্তার গত সপ্তাহে এক বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আশির দশকে চিন সরকারই খেলোয়াড়দের ডোপিংয়ের ব্যবস্থা করে দিত। উত্তরে চিনা সাঁতার দলের নেতা য়ু কি বলছেন, “চিন এত বড় দেশ। সেখান থেকে কোনও জিনিয়াস সাঁতারু বেরোতে পারে না বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে কেন?”
য়ি শিওয়েন সাঁতারের পুলে যে ‘অঘটন’ ঘটিয়েছেন, এমনও নয় যে তার সমতুল্য নজির অতীতে নেই। ১৯৭৩ সালে বিলি জিন কিং তাঁর চেয়ে ২৬ বছরের বড় ববি রিগসকে স্ট্রেট সেটে হারিয়েছিলেন। ‘ব্যাটল অফ সেক্সেস’ নামে বিখ্যাত সেই ম্যাচ। সেরেনা উইলিয়ামস কোনও কোনও দিন আন্দ্রে আগাসির থেকেও জোরে সার্ভ করেছেন। ২০০৩ সালে গল্ফার অ্যানিকা সোরেনস্ট্যাম এক ঝাঁক পুরুষের সঙ্গে পিজিএ ট্যুরে খেলেছিলেন। শেষ দুই রাউন্ডে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি।
তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, সাধারণ ভাবে খেলাধুলোয় পুরুষ ও মেয়েদের ‘শক্তি’র ফারাক অনেকটাই। ১০০ এবং ২০০ মিটারে উসেইন বোল্টের বিশ্বরেকর্ড ৯.৫৮ সেকেন্ড এবং ১৯.১৯ সেকেন্ডের। ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের মেয়েদের স্প্রিন্টে বিশ্বরেকর্ড সেখানে ১০.৪৯ সেকেন্ড এবং ২১.৩৪ সেকেন্ড। ৪০০ মিটারে মাইকেল জনসনের (৪৩.১৮) অনেক পিছনে মারিতা কখের বিশ্বরেকর্ড (৪৭.৬০)। সাঁতারে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইতে ফেল্পসের বিশ্ব রেকর্ড ৪৯.৮২ সেকেন্ডের। মেয়েদের ডানা ভোলমারের রেকর্ড ৫৫.৯৮ সেকেন্ড। ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে ব্রাজিলের সিজার সিয়েলোর বিশ্বরেকর্ড ৪৬.৯১ সেকেন্ড, জার্মান মেয়ে ব্রিটা স্টেফেনের বিশ্বরেকর্ড ৫২.০৭।
এই আবহে ‘সুপার গার্ল’ য়ি এমন দুর্দান্ত সময় করলেন কী করে? সোমবার ২০০ মিটার মেডলির হিটে তৃতীয় হয়েছিলেন মার্কিন তরুণী কেইটলিন লেভেরেনজ্। য়ি-কে পরোক্ষ সন্দেহ তাঁরও। “চিনাদের ডোপিংয়ের লম্বা ইতিহাস আছে। যাঁরা আঙুল তুলছেন, তাঁরা পাগল নন।” লিওনার্ড বিদ্রুপ করে বলছেন, “য়ি-কে সুপারউওম্যানের মতো লাগছে। অতীতে যখনই কাউকে সুপারউওম্যানের মতো লেগেছে, সে পরে ডোপের দায়ে ধরা পড়েছে।” ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার য়ি শিওয়েন অগত্যা নিজে মুখ খুলেছেন। বলেছেন, “কঠোর পরিশ্রমই আমাকে সাফল্য দিয়েছে। নিষিদ্ধ ওষুধ নয়।”
শিওয়েনের সঙ্গে সহমত আরও অনেকে। মার্কিন জাতীয় সাঁতারদলের কোচ ফ্রাঙ্ক বুশের কথায়, “শিওয়েন সকলকে চমকে দিয়েছেন। ঠিক যেমন ২০০৮-এ চমকে দিয়েছিলেন উসেইন বোল্ট!” সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট এসেছে চিনাদের ‘আক্রমণের লক্ষ্য’ মাইকেল ফেল্পসের কোচ বব বাউমানের কাছ থেকেই। “প্রমাণ ছাড়া কিছু বলা ঠিক নয়। আমার য়ি-র টেকনিক দারুণ লেগেছে।” ব্রিটিশ অলিম্পিক কমিটির প্রধান কলিন ময়নিহানও বলছেন, “শিওয়েনের ডোপ পরীক্ষা হয়েছে। ওয়াডা বলেছে, ও মুক্ত। ব্যস, গল্প শেষ।”
শেষ কোথায়? অলিম্পিকের পদক-যুদ্ধের মতোই মাঠের বাইরেও চিন বনাম আমেরিকা যুদ্ধ কিন্তু সহজে থামছে না! |