সি পি আই এম বনাম সিটু। একটি পূর্ণাঙ্গ কাজের দিনকে কর্মনাশা পরিবহণ ধর্মঘটে বিপর্যস্ত করিয়া দিবার হঠকারিতা হইতে সিটুর প্রত্যাবর্তনের পিছনে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অর্থাৎ সি পি আই এমের রাজ্য নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা রহিয়াছে, ইহা সিটু নেতৃত্বও স্বীকার করিয়াছেন। ভারতে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল তাহাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনকে দিয়া দলীয় কর্মসূচি কার্যকর করে। শ্রমিক ফ্রন্টে এই ধরনের প্রয়াস লক্ষ করা যায় বিভিন্ন দলের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই সেই ফ্রন্টের সহিত দলের সম্পর্কে একটা টানাপড়েন চলে, দল ফ্রন্টকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে না। চাহেও না, কারণ শ্রমিক সংগঠন বা অনুরূপ বিভিন্ন ফ্রন্টের যূথশক্তি দলের কাজে লাগে। সি পি আই এমের ক্ষেত্রেও এই টানাপড়েন আছে। এ বারের পরিবহণ ধর্মঘটের ক্ষেত্রে অন্তত দেখা গেল, সেই টানাপড়েনে দলের সংযমী তথা বিবেচক অংশটিই জয়ী হইয়াছে, শ্রমিক সংগঠনের জঙ্গি নেতিবাদ পরাজিত হইয়াছে।
ইহার পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠোর অবস্থানের একটি ভূমিকা থাকা সম্ভব। ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে হইতেই তিনি বন্ধ-অবরোধ-ধর্মঘটের বিরুদ্ধে অবস্থান লইয়াছিলেন। তাহার সুফলও দেখা যায়। বন্ধ, অবরোধের বিরুদ্ধে রাজ্যের স্থানে স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-প্রতিবাদ শুরু হয়। অবরোধকারীদের হটাইয়া জনগণ রেলপথে ট্রেন চালু রাখিতে সচেষ্ট হন। বন্ধ-এর দিনেও জনসাধারণকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য পরিবহণের আশায় পথে বাহির হইতে দেখা যায়। সি পি আই এমের মতো দলের মধ্যেও এমন নেতারা ছিলেন, যাঁহারা বন্ধ-এর মতো কর্মনাশা আত্মঘাতের বিরোধী। মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও আক্ষেপ করিতে শুনা গিয়াছে যে, তিনি না চাহিলেও দল ও ট্রেড ইউনিয়নের জবরদস্তিতে অচলাবস্থা শিরোধার্য করিতে হইতেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হইল, দল-পরিচালনায় তাঁহাকে বামেদের ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নীতি মানিয়া চলিতে হয় না। তিনি যাহা মনে করেন, সেটাই দলের নীতির চেহারা পায়। তাই বুদ্ধদেববাবুদের মতো দ্বিধা তাঁহার সিদ্ধান্তগ্রহণে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় না।
বাম নেতারা কি এই দরকারি শিক্ষাটুকু গ্রহণ করিতে পারেন? উন্নয়নের জন্য কর্মনাশা আন্দোলনকে যদি দলের কর্মসূচি হইতে নির্বাসিত করিতে হয়, তবে সাহসের সহিত তাহা করার সততা অনুশীলন করিতে পারেন? পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন, রাজ্যবাসীর কল্যাণ কিন্তু এমনই দাবি করিতেছে। রাজ্য একটা সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। লগ্নিকারীরা বন্ধ্যা রাজনীতির অবসানের সম্ভাবনায় আবার রাজ্য সম্পর্কে আগ্রহী। এমনিতে অলস, তর্কশীল, নৈরাজ্যপ্রিয় রাজ্যবাসীর মধ্যেও আলস্য, ফাঁকিবাজি ছাড়িয়া জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাড়তি পরিশ্রম করার আকাঙ্ক্ষা দেখা যাইতেছে। নূতন শাসক দল পূর্বসূরির সংস্কার বর্জন করিয়া নূতন উদ্দীপনা লইয়া শুরু করিয়াছে। কিন্তু বিরোধীদের সহযোগিতাও দরকার। বামপন্থী রাজনীতিকরা উপলব্ধি করিতেছেন, অচলাবস্থা আবাহনের রাজনীতি নয়, গঠনমূলক সমালোচনাই রাজ্যের উত্তরণের সোপান। দায়িত্ব তাঁহাদেরও। ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের চোরাবালি হইতে বাহির হইতে তাঁহারা আপন ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে নিবৃত্ত করিতে পারেন। তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির উত্তরণ ঘটিতে পারে। নেতি হইতে ইতির মার্গে উত্তরণ। |