তাঁকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের আবেগ দেখে ‘টু স্যর, উইথ লাভ’-এ লন্ডনের স্কুল-শিক্ষক মার্ক থ্যাকারে অন্য চাকরির ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার’টা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। হিঙ্গলগঞ্জের স্কুল-শিক্ষক সুব্রত গাইন ছাত্রছাত্রীদেরই বললেন, “তোরা ক্লাসে চল। পরীক্ষার আগে এ ভাবে ক্লাস বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। আমি আর অন্য স্কুলে যাব না।”
‘এ ভাবে’ মানে কেঁদে, স্কুল চত্বরে শুয়ে পড়ে, ক্লাস বয়কট করে শনিবার সকাল থেকে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়েছিল পূর্ব খেজুরবেড়িয়া এম সি ইনস্টিটিউশনের পড়ুয়ারা। তবে শারীর-শিক্ষার শিক্ষক ‘সুব্রত স্যার’-এর আশ্বাস পেতেই কান্না পলকে বদলাল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে।
১৯৬৭-র ‘টু স্যর, উইথ লাভ’ ছবি দেখিয়েছিল, অবাধ্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে টানতে স্রেফ ‘কেজো’ পড়ানো নয়, ‘অন্য পথে’ হাঁটছেন শিক্ষক মার্ক থ্যাকারে। তাদের ব্যক্তিগত কথা শুনে, তাদের মতো করে মিশে, তাদের সম্মান দিতে শিখিয়ে পাচ্ছেন পাল্টা সম্মান আর ভালবাসা।
বছর চল্লিশের সুব্রতবাবুর ছাত্রছাত্রীরা কেউই অবাধ্য নয়। তাদের সমস্যা, দারিদ্র। কিন্তু সেই দারিদ্র যাতে তাদের পড়াশোনায় প্রভাব না ফেলে, সে জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা চালিয়েছেন ২০০৪ সালে ওই স্কুলে যোগ দেওয়া সুব্রতবাবু। |
সুব্রত গাইনকে জড়িয়ে ধরে কান্না ছাত্রদের। —নিজস্ব চিত্র |
রসায়নের স্নাতক, নিয়েছেন শারীর-শিক্ষার প্রশিক্ষণও। বারাসতের বাসিন্দা ওই শিক্ষক প্রথম দিকে কয়েক বছর স্কুলের হস্টেলে থেকে শিক্ষকতা করেছেন। সকাল-সন্ধ্যায় ছাত্রছাত্রীদের নিখরচায় পড়িয়েছেন, বইখাতা কিনে দিয়েছেন। এমনকী, বিপদে-আপদে তাদের টাকাও দিয়েছেন। এত বছর ধরে এ ভাবেই বিপদে-আপদে ছাত্রছাত্রীদের বড় ভরসা হয়ে উঠেছিলেন ‘সুব্রত স্যার’। শারীর-শিক্ষার ক্লাস নেওয়া ছাড়াও অঙ্ক, বিজ্ঞানও পড়ান তিনি। তাই শুক্রবার স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন শোনে, সুব্রতবাবু অন্য স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।
শুক্রবার স্কুলে আসেননি সুব্রতবাবু। শনিবার এসে পরিস্থিতি দেখে চমকে যান। প্রধান শিক্ষক না আসায় সহকারী প্রধান শিক্ষক অসিতকুমার যাদবের উদ্যোগে সুব্রতবাবুকে নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষিক-শিক্ষিকা এবং স্কুল পরিচালন সমিতির সদস্যেরা। বাইরে সেই সময়ে বিক্ষোভ দেখায় পড়ুয়ারা। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও সুব্রতবাবুকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। পরে বাইরে এসে সুব্রতবাবু সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “আমি যা করেছি, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার এই সব ছাত্রছাত্রীদের ভালর জন্যই। ব্যক্তিগত কারণেই আমি সোনারপুরের একটি স্কুলে ‘মিউচুয়াল ট্রান্সফার’-এর আবেদন জানিয়েছিলাম। তা মঞ্জুর হয়েছে। কিন্তু এখানে যে এত কাণ্ড হবে ভাবিনি!” প্রধান শিক্ষক সমরেশচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “আমরাও চাই, সুব্রতবাবু স্কুলে থাকুন। তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে স্কুলে থেকে যেতে চাইলে, এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না।” দিনভর এত কাণ্ডের পরে ‘সুব্রত স্যার’ স্কুল ছাড়ছেন না জেনে উচ্ছ্বাস লুকোয়নি ছাত্রছাত্রীরা। দ্বাদশ শ্রেণির মানস মণ্ডল বলে, “আমাদের বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকেও স্যার পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। বলেছেন, শুধু চাষ করলেই হবে না। আমরা পড়ছি কি না, বাড়ি এসে খোঁজ নিতেন।” পাশ থেকে আর এক ছাত্র বলে ওঠে, “স্যারের জন্যই তো স্কুলে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাটমিন্টন প্রতিযোগিতা শুরু হল।” একাদশ শ্রেণির পিয়ালি গিরি বলে, “বিপদে-আপদে আমাদের পাশে দাঁড়ানো স্যারের অভ্যাস। ওঁর ঋণ শোধ হওয়ার নয়।”
|