মদ্যপদের হাতে ছাত্রী-নিগ্রহ বোঝাল বারাসত অরক্ষিতই
পাল্টায়নি কিছুই। শুধু বদলে গিয়েছে ‘নিগৃহীতা’র মুখ।
দেড় বছর আগে এক রাতে বাড়ি ফেরার সময় দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন রিঙ্কু দাস। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন ভাই রাজীব দাস। আর শুক্রবার আক্রান্ত হলেন দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী। তাঁকে বাঁচাতে এসে দুষ্কৃতীদের হাতে মার খেলেন তাঁর বাবা। তখন সবে রাত সওয়া ৮টা। ঘটনাস্থল বারাসত স্টেশন লাগোয়া সেই চত্বর, যা গত দেড় বছর ধরে শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, লুঠপাটের পরপর ঘটনায় পুলিশি ‘অকর্মণ্যতা’রই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
এই ঘটনার পরে আক্রান্তের বাড়ি যান বারাসতের বিধায়ক তথা অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। কিন্তু তিনি ঘটনাটিকে কার্যত অনিবার্য বলে ধরে নিয়েছেন! বলেছেন, “ইভ-টিজিং অতি প্রাচীন। রামায়ণে শুধু রাম নয়, রাবণও ছিলেন। সিনেমায় ভিলেন থাকে। না-হলে গল্প-উপন্যাস-সিনেমা কিছুই হয় না!” বিধায়কের এই মন্তব্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে সব মহলে। ঘটনাটিকে ‘অনভিপ্রেত’ বলেও চিরঞ্জিত মন্তব্য করেছেন, এর পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের পোশাক দায়ী থাকে। তাঁর এই মন্তব্য নতুন বিতর্কে ইন্ধন দিয়েছে। আর ঘটনাস্থলে সন্ধ্যা থেকে আইনশৃঙ্খলা বলে যে কিছুই কার্যত থাকে না, পিছনে চলে গিয়েছে এই ভয়াবহ ছবিটা।
নিহত রাজীবের দেহ যেখানে পড়ে ছিল, বারাসত স্টেশনের বাইরে ‘ওভারব্রিজের’ ঠিক নীচের সেই এলাকাতেই প্রথম ‘আক্রান্ত’ হন দ্বাদশ শ্রেণির এই ছাত্রী। স্টেশন তখন গমগম করছে। এই ঘটনায় অবশ্য স্তম্ভিত নন রাজীবের দিদি রিঙ্কু। ভাইকে হারানোর পরে এখন রাতে আর ওই পথে যেতে সাহস পান না তিনি। রিঙ্কু বলছেন, “আমাদের সঙ্গে যা ঘটেছিল, তার পরে এক বার রাতে ওই তল্লাট দিয়ে ফিরেছি। তখন কিন্তু টের পেয়েছি, ওই চত্বর মোটেও পাল্টায়নি।” নিজে যেমন ওই ভয়াবহ রাতের কথা ভুলতে পারেননি আজও, তেমনই মনে করেন, এই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না স্কুলে পড়া মেয়েটির। ঘটনাও তাই। শুক্রবার ভরসন্ধ্যায় টিউশন পড়ে বাড়ি ফেরার পথে ওই ছাত্রীটিকে যে বিপদের সম্মুখীন হতে হল, তার ধাক্কায় শনিবার দিনভর গুটিয়ে ছিল তাঁদের গোটা পরিবার। ছাত্রীটি কারও সঙ্গে কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর বাবা বারাসতে জেলা পরিষদের কর্মী মধুসূদন সাহার দুশ্চিন্তা, “এর পরে ওই রাস্তা দিয়ে মেয়ে পড়ে ফিরবে কী করে?”
কয়েক দিন আগেই ‘প্রতিবাদী’ শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস খুন হওয়ার পরে বারাসতের দোলতলায় বৈঠক করতে গিয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের সমালোচনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরেও কিন্তু বদলায়নি বারাসতে পুলিশি নজরদারির ছবিটা। শ্লীলতাহানি বা লুঠ-ছিনতাইয়ের পরে দুষ্কৃতীরা ধরা পড়ে ঠিকই, কিন্তু অপরাধপ্রবণতায় ভাটা পড়ে না।
কেন? বারাসত স্টেশনের কাছে গা-ছমছমে গলি, ‘দুর্বৃত্ত’দের উন্মুক্ত ‘পানশালা’ সবই বহাল তবিয়তে আছে। এলাকা ঘুরলেই বোঝা যায়, মদ্যপান থেকে শুরু করে যাবতীয় দুষ্কর্মের পক্ষে জায়গাটি যেন স্বর্গ। বারাসত স্টেশন থেকে বনগাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডান দিকে পড়ে এই এলাকা। রেল লাইন লাগোয়া যে আলো-আঁধারি গলি দিয়ে ধরে বনমালীপুরের দিকে হাঁটছিলেন ওই ছাত্রী, তার ধারেই ওই সব পানশালা। ওই গলির পাশেই আবার জেলাশাসক-পুলিশ সুপারের বাংলো বা আদালতের ধার ঘেঁষা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। দিনের বেলা জমজমাট এই অফিস চত্বরটি সন্ধ্যা নামতেই সুনসান হয়ে যায়।
এবং হয়ে ওঠে দুর্বৃত্তদের আড্ডা। ভিড় বাড়ে বেআইনি মদের ঠেকগুলিতে।
দেড় বছর আগে ওই রাস্তাতেই দুষ্কৃতীদের খপ্পরে পড়েন রিঙ্কু। তখনও মদের ঠেকগুলি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখনও সেগুলি স্বমহিমায় বিরাজ করছে। ওই রাস্তায় বারাসত হাসপাতালে যাওয়ার পথেও রাতে অনেককে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। আক্রান্ত হয়েছেন সস্ত্রীক পুলিশকর্মীও। তবু আজও পুলিশের নজরদারি কার্যত শূন্য। শুক্রবার পরিস্থিতির শিকার হলেন ওই স্কুল ছাত্রী।
অভিযোগে বলা হয়েছে, স্টেশনের একেবারে কাছে কিছু যুবকের অশালীন মন্তব্যে থমকে দাঁড়ান ওই ছাত্রী। এর পরে দ্রুত বনমালীপুরের দিকে রেললাইন ঘেঁষা গলি ধরে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। তাঁর পিছু নেয় দুষ্কৃতীরা। ফোন করে মা-বাবাকে সঙ্গে-সঙ্গে খবরও দেন মেয়েটি। তাঁর বাবা কাছেই দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। বন্ধুর মোটরবাইকে করে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হন। তখন ওই ছাত্রীটির সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ধস্তাধস্তি চলছে। মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে মধূসূদনবাবুও আক্রান্ত হন। চিৎকার-চেঁচামেচিতে স্টেশনের দিক থেকে কয়েক জন চলে আসেন। তাঁদের হাতেই এক অভিযুক্ত ধরা পড়ে। পুলিশ জানায়, ধৃত যুবক রমেশ দাসের বাড়ি বারাসতের উত্তরায়ণপল্লিতে। সে রান্নার কাজ করে। জনতার মার খাওয়ার পরে বারাসত হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়। ওই রাতেই শুভঙ্কর দাস নামে আর এক যুবক ধরা পড়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, শুভঙ্কর দুষ্কৃতীদের বন্ধু। পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। দুষ্কৃতীরা স্টেশনের কাছে স্ট্যান্ডে মোটরবাইক ফেলে চলে গিয়েছিল। শুভঙ্কর পরে সেই বাইকটি নিয়ে যেতে গিয়েই ধরা পড়ে। এই দু’জনকেই আদালতে তোলা হলে ১৪ দিনের জন্য তাদের জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। তবে বাকি দুষ্কৃতীরা কেউ এখনও ধরা পড়েনি।


বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.