|
|
|
|
বিধায়ক চিরঞ্জিতের ‘মৌলবাদী’ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ বিশিষ্টরা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ছিলেন সিনেমার ‘সংবেদনশীল’ নায়ক। এখন আবার বিধায়কও, শাসক তৃণমূলের। মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণের কারণ হিসাবে তাঁদের পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে সেই চিরঞ্জিতের মন্তব্যে সমাজের একটি বড় অংশ কার্যত স্তম্ভিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ একে এক ধরনের ‘মৌলবাদ’ বলে উল্লেখ করছেন। চলচ্চিত্র মহল থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক সকলেরই বক্তব্যের মূল সুর, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই ধরনের মানসিকতা সামাজিক শ্লীল-অশ্লীলতার বিচারের মাপকাঠি কী করে হতে পারে?
চিরঞ্জিত বলেছেন, “মেয়েদের পোশাকের ধরন বদলাচ্ছে। সেটা পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। তা নিয়ে কটূক্তি করলেই তাকে ‘স্ল্যাং’ বা ‘টন্ট’ বলা হয়। শুক্রবার রাতে যা হয়েছে।” এই মন্তব্যেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কোনটা শ্লীল কোনটা অশ্লীল পোশাক, তার সংজ্ঞা কি মেয়েদের শিখতে হবে সমাজের স্বঘোষিত ‘পোশাক-পুলিশ’-এর কাছ থেকে? কেন এক শ্রেণির পুরুষের বিকৃত কামকে ধামাচাপা দিতে বারবার মেয়েদের পোশাককে কাঠগড়ায় তোলা হবে? |
বারাসত আছে বারাসতেই |
২০১২, ২৭ জুলাই |
রাত সওয়া ৮টা স্টেশনের বাইরে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে কটূক্তি, ধাওয়া মদ্যপ দুষ্কৃতীদের। ছাত্রীর বাবাকে মার। ধৃত ২। |
২০১২, ২৭ এপ্রিল |
রাত ৯টা দাদার সাইকেলে চেপে ফেরার সময় হেলাবটতলার কাছে অপহৃত পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী। পরে মুক্তিপণে মুক্ত। |
২০১১, ২ সেপ্টেম্বর |
বিকেল সাড়ে ৫টা জেলাশাসক অফিসের অদূরে পুলিশকে লক্ষ করে গুলি। সঙ্গে সঙ্গে ধৃত ১। উদ্ধার পিস্তল। |
২০১১, ২ অগস্ট |
রাত ৮টা। ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে দেখে স্টেশন সংলগ্ন বাড়িতে ফেরার সময় আক্রান্ত পুলিশকর্মী ও তাঁর স্ত্রী। দু’জনই গুরুতর জখম। |
২০১১, ১৪ ফেব্রুয়ারি |
রাত সাড়ে ১০টা ভাইয়ের সাইকেলে স্টেশন থেকে ফেরার পথে আক্রান্ত রিঙ্কু দাস। বাধা দিতে গিয়ে খুন ভাই রাজীব দাস। |
|
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “অনেক আগে অল্পবয়সী মেয়েরা বিধবা হলে চুল কেটে, সাদা থান পরিয়ে রাখা হত। যুক্তি দেওয়া হত, এতে তাঁরা পুরুষের চোখে পরবেন না, যৌন কামনার শিকার হবেন না। এত করে কি অল্পবয়সী বিধবাদের উপর যৌন অত্যাচার এড়ানো গিয়েছিল?” তাঁর আরও যুক্তি, “দিন কয়েক আগে কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে যে মেয়েটি ধর্ষিতা হলেন, তাঁর পরনে একটা রঙচটা শাড়ি ছিল। তা হলে তিনি কেন ধর্ষিতা হলেন?”
মেয়েদের পোশাকের উপর কোনও রকম ফতোয়া দেওয়াকে নস্যাৎ করে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “মেয়েরা কোন পোশাক পরে বার হবে, সেটা মেয়েরা ঠিক করবে। এর উপর যারা ফতোয়া জারির চেষ্টা করবে, তারা মৌলবাদী। এরা যত তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে বিদেয় হয়, ততই ভাল।” কথা বলতে গিয়ে বারবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন নারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শাশ্বতী ঘোষ। “এক জন শিল্পী, জনপ্রতিনিধি কী করে এমন অবাঞ্ছিত মন্তব্য করতে পারেন? প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বারাসতের ওই জায়গায় রিঙ্কুকে ইভটিজারদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। রিঙ্কু কি খোলামেলা পোশাক পরেছিলেন?” |
|
বিতর্কের দিনেই এক অনুষ্ঠানে তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় |
অন্য যুক্তি টেনে এনেছেন পরিচালক-অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘো•ধরা যাক একটা মেয়ে স্বল্পবসনা, তার মানেই সে ভোগ্যা? পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পরও বলা হয়েছিল, মেয়েটির অত রাতে বাইরে থাকা উচিত হয়নি। এটা তো অপরাধীকে বাঁচাতে ছিদ্রসন্ধান করা।” আর একটু ব্যাখ্যা দেন ঋতুপর্ণ, “যেমন রাস্তায় টাকাভর্তি একটা ব্যাগ পড়ে রয়েছে। সেটা থানায় জমা না-করে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়, তেমনি একটি মেয়েকে আকর্ষণীয়া লাগলেই যেন আত্মসাৎ করার অধিকার জন্মায়! আমি এর জন্য কোনও বিশেষ প্রশাসনকে দোষ দেব না। এটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী। অতীতে কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষ যখন বলেছিলেন, মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ পরা চলবে না, তখন আমরা বুঝেছিলাম সেটা রক্ষণশীলতা। কিন্তু এখনকার এই ঘটনাগুলিতে আমাদের শুভবুদ্ধি গুলিয়ে যায়।” প্রায় একই মন্তব্য শিল্পী শুভাপ্রসন্ন-র, “কাউকে দেখে আমাদের আকর্ষণীয়া মনে হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তো তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ভোগের অধিকার জন্মায় না।” একই কথা বলেছেন লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য, “একটি মেয়ের পোশাক দেখে যদি তার শ্লীলতাহানি করার ইচ্ছে জাগে কোনও পুরুষের, তা হলে এমন পুরুষদের সমাজ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।” তাঁর বক্তব্য, “চিরঞ্জিতের মতো এক জন শিল্পীর মুখ থেকে এমন মন্তব্য শুনে ভীষণ অবাক হয়েছি।” পরিচালক-অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় মেয়েদের পোশাকের উপর এই আঙুল তোলাকে পুরুষের ‘পরোক্ষ যৌনচর্চার আনন্দ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কৌশিক পাল্টা বলেছেন, “লেডি ডায়ানা ওপেন শোল্ডার পোশাক পরলে সারা বিশ্ব মুগ্ধ হত। শাড়ি অনেক অশ্লীল ভাবে পরা যায়। শাড়ি পড়লেই মেয়েরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা রাজনীতিকরা দিতে পারবেন তো?”
|
তাজ্জব বাত |
মেয়েদের পোশাকের ধরন বদলাচ্ছে। সেটা পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য।
মেয়েদের পোশাক নিয়ে কটূক্তি করলেই তাকে স্ল্যাং বা টন্ট বলা হয়।
শুক্রবার রাতে যা হয়েছে।
চিরঞ্জিত |
যদি কোনও মানুষের মন বিকৃত হয় তা হলে সর্বশরীর ঢাকা একটা মেয়েকে দেখেও তার কাম জাগতে পারে।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত |
উটকো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে বেশি খোলামেলা পোশাক রাস্তায় না পরাই ভাল।
স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় |
|
মেয়েদের পোশাক নিয়ে যারা ফতোয়া জারি করে তারা মৌলবাদী। এরা যত তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে বিদেয় হয় ততই ভাল।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
কাউকে দেখে আকর্ষণীয়া মনে হতে পারে, তা বলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ভোগ করার অধিকার জন্মায় না।
শুভাপ্রসন্ন |
|
পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে বলা হয়েছিল অত রাতে মেয়েটির বাইরে থাকা উচিত হয়নি। এ তো অপরাধীকে বাঁচাতে ছিদ্রসন্ধান।
ঋতুপর্ণ ঘোষ |
একটি মেয়ের পোশাক দেখে যদি তার শ্লীলতাহানি করার ইচ্ছে জাগে কোনও পুরুষের, তা হলে এমন পুরুষদের সমাজ থেকে বের করে দেওয়া উচিত।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য |
|
অভিনেত্রী স্বস্তিকা বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন একটু অন্য ভাবে। তাঁর মতে, ‘ঠিকঠাক’ পোশাক পরলেই যে মেয়েদের প্রতি কেউ অশালীন আচরণ করবে না, তা নয়। তবে “উটকো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচতে বেশি খোলামেলা পোশাক রাস্তায় না পরাই ভাল।” তাঁর কথার সঙ্গে অবশ্য একমত হতে পারেননি অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা। তাঁর মতে, “যদি কোনও মানুষের মন বিকৃত হয়, তা হলে সর্বশরীর ঢাকা একটা মেয়েকে দেখেও তার কাম জাগতে পারে। এখানে পোশাকটা কোনও ইস্যু নয়।” একই ভাবে ডিজাইনার দেব মনে করেন, “ইভটিজাররা মানসিক ভাবে অসুস্থ। মেয়েদের পোশাকটা বাহানা, মেয়েদের হাসি দেখলেও তাঁরা উত্তেজিত হতে পারে।” বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি অভিনেত্রী-বিধায়ক শতাব্দী রায়ের সঙ্গে। তবে এ দিন তাঁকে শহরের এক অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছে রীতিমতো ‘হাল ফ্যাশান’-এর পোশাকে।
যুগযুগান্ত ধরে লিঙ্গরাজনীতির এই একপেশে নীতির জন্যই গত বছর মার্চে নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত ‘কমিশন অন দ্য স্টেটাস অফ উইমেন’-এ ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর তরফ থেকে বলা হয়েছিল, নারীর যৌনতার উপর কর্তৃত্ব করতে চাওয়া এবং তার স্বাধীনতাকে খর্ব করার সুপ্ত বাসনা নিয়েই মেয়েদের উপর পোশাক-বিধি আরোপ করা হয়। দাবি উঠেছিল, সেই পোশাক-অনুশাসন ভেঙে ফেলার। সত্যি তা পারা যাবে কি না, ভবিষ্যৎ জানে। |
|
|
|
|
|