|
|
|
|
|
মস্তিষ্কের সরস
ব্যবহারেই জিতল লন্ডন
শ্রাবণী বসু • লন্ডন |
|
চার বছর আগে বেজিং গোটা বিশ্বকে হেঁকে বলেছিল, ‘‘এই যে, আমায় দেখো!’’
লন্ডন শুধু বলল, ‘‘দেখো ভাই! আমি যা, আমি তা-ই।”
উদগ্র দেখানেপনার জবাবে স্মিত ঠাট্টা! আড়ম্বরের বদলে মস্তিষ্কের প্রয়োগ! বেজিংয়ের কিস্তি এতেই মাত করল লন্ডন!
বাকিংহামের অধীশ্বরীও গত ৬০ বছরে যা করেননি, এ বার করলেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ‘সিনেমায় নামলেন’! লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ‘মাথা’ ড্যানি বয়েল একটি ফিল্ম ক্লিপ ব্যবহার করেছেন। সেখানে রানিকে বাকিংহাম থেকে অলিম্পিক প্রাঙ্গণে নিয়ে আসছেন জেমস বন্ড ড্যানিয়েল ক্রেগ। হেলিকপ্টার থেকে প্যারাশু্যটে নামার দৃশ্যটায় ‘ডামি’ আছে ঠিকই। কিন্তু ‘গুড ইভনিং, মিস্টার বন্ড’ বলে ক্রেগকে সম্ভাষণ করলেন যিনি, তিনি সত্যিকার রানিমা-ই বটে!
লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী মেজাজ আসলে এটাই তুখোড় মজা, মস্তিষ্কের ব্যবহার এবং বনেদিয়ানার ঘেরাটোপ ছেড়ে বহুত্বের আলিঙ্গন! |
|
মডেল-অ্যাথলিট। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্যারাগুয়ের লেরিন ফ্রাঙ্কো। ছবি: এএফপি |
বৈভব, প্রাচুর্য আর প্রযুক্তি কত দূর চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে, চার বছর আগে সেটা দেখিয়েছিল বেজিং। সেই ঘোর আজও পৃথিবীর চোখে লেগে আছে। অবধারিত যে প্রশ্নটা তাই সকলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘এর পরে আর কী দেখার বা দেখানোর থাকতে পারে?’ উত্তরটা ব্রিটেনের হয়ে ড্যানি বয়েল দিয়ে দিলেন। দু’কোটি ৭০ লক্ষ পাউন্ডের বাজেট (বেজিংয়ের অর্ধেকও নয়), শ’তিনেক স্কুল পড়ুয়া আর মেরেকেটে সাড়ে ন’শো ছেলেমেয়ে-ড্রামবাজিয়েকে নিয়ে তিনি যেটা করে দেখালেন, তার সম্বল স্রেফ একটাই মস্তিষ্ক। ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’-এর জীবনদর্শন আরও এক বার জিতে গেল লন্ডনের স্টেডিয়ামে।
নাচ-গান-সিনেমা-থিয়েটার মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার যে কোলাজটা হাজির করলেন ড্যানি, সেটা কখনও মাথা ঘুরিয়ে দিল! কখনও চোখে জল আনল! কখনও দুঃসাহসিকতার বহরে হতচকিত করে দিল! বেজিংয়ে শুরু থেকে শেষ অবধি ছিল বেবাক বিস্ময়! আর লন্ডন যেন মস্তিষ্ক থেকে হৃদয় ছুঁয়ে আবার মস্তিষ্কে পৌঁছে দিল। ভাবিয়ে তুলল!
জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা আর বিখ্যাত অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের অংশটি যেমন! দত্যিদানোর হানা (তার মধ্যে লর্ড ভলডেমর্টও আছে) থেকে অসুস্থ শিশুদের যে ভাবে বাঁচাল মেরি পপিন্স, তার পরে আর ডেভিড ক্যামেরনের পক্ষে এই পরিষেবায় কাটছাঁট করা সম্ভব হবে কি? গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে! তার পর ধরা যাক, ব্রিটেনে রাজনৈতিক বিক্ষোভের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন ড্যানি। তার মধ্যে ভোটাধিকারের জন্য লড়া মহিলারা আছেন, বেকারির বিরুদ্ধে ১৯৩৬ সালের জ্যারো-মিছিলের প্রসঙ্গ আছে। আবার, সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে সরব আফ্রো-ক্যারিবীয় অভিবাসীরাও আছেন! এবং সবচেয়ে বড় কথা ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যরা আছেন! যেখানে গত কয়েক বছরে ব্রিটেনে ট্রেড ইউনিয়নের উপরে একাধিক বাধানিষেধ নেমে এসেছে, সেখানে ক্যামেরনের নাকের ডগা দিয়েই অলিম্পিক-মঞ্চে তাদের হাজির করেছেন ড্যানি! ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক সদস্য তো টুইট করেছেন, “এমন বাম-ঘেঁষা উদ্বোধন অনুষ্ঠান কস্মিন কালে দেখিনি! কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের রাজধানী বেজিংয়েও না!” |
|
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে কখনও মাথা তুলল শিল্প বিপ্লবের চিমনি, কখনও গল্পের চরিত্রদের
সঙ্গে হাজির হলেন হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রোওলিং, আবার কখনও পশুপালকের
বেশে কলাকুশলীরা। ছবি: পিটিআই, এএফপি |
কী করেই বা দেখবেন? ড্যানি নিজেই তো বলছেন, গোটা অনুষ্ঠানটা তিনি সাজিয়েছেন একেবারে নিজের মতো করে! কোনও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না। সেই জন্যই তিনি ঠিক করে নিতে পেরেছিলেন, ‘ব্রিটেন’কে ঠিক কোন চেহারায় তুলে ধরবেন! ইতিহাস আর সংস্কৃতি, অতীত আর বর্তমানের কোন কোন চিহ্ন বেছে নেবেন! সেখানে লন্ডন সিম্ফনি অর্কেস্ট্রাও থাকবে, সেক্স পিস্তলসও থাকবে। শেক্সপিয়রও থাকবে, মিস্টার বিনও থাকবে। স্পিনিং জেনিও থাকবে, সোশ্যাল মিডিয়াও থাকবে। চার্লি চ্যাপলিনও থাকবে, চুম্বনরত সমকামীযুগলও থাকবে! ‘পাখির বাসা’ নয়, ড্যানি বেছে নেবেন খোলা মাঠ! সবুজ ঘাস আর পপি ফুলের বাহার! গরু-ভেড়া-ঘোড়ার সমাহার! টিউডর ইংল্যান্ডের ইতিহাস-বই থেকে উঠে আসা যেন! সূচনায় বৃহৎ ঘণ্টাধ্বনির পরে এই মার্কামারা ব্রিটিশ ‘কান্ট্রিসাইডে’রই রূপ নিল অলিম্পিক চত্বর। ভেসে বেড়াল মেঘ, আবহাওয়া নিয়ে ব্রিটিশদের চিরকালীন খুঁতখুতেমি নিয়ে মৃদু খোঁচা! তার মধ্যে থেকেই ‘দ্য টেমপেস্ট’-এর ক্যালিবান-সংলাপ আওড়াতে আওড়াতে উনিশ শতকের নামী ইঞ্জিনিয়ারের বেশে বেরিয়ে এলেন অভিনেতা কেনেথ ব্রানাগ! মাঠ বদলে গেল কারখানার শেডে, অতিকায় চিমনিরা গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল! ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব এল!
কারখানা-শ্রমিকদের ভিড়েই তার পর ক্রমে মিশে গেল আন্দোলনের নানা স্রোত। মনে করিয়ে দিল, ব্রিটেনের রাজনীতি মানে শুধু টোরি-হুইগ নয়। অ্যানার্কিস্ট চিন্তারও অন্যতম ধাত্রীভূমি এই দেশ। লন্ডন মানে শুধু ইংল্যান্ড নয়। আরও চার-চারটি দ্বীপরাজ্যও। ব্রিটেন মানেও শুধু ব্রিটিশ নয়, আরও নানা জনগোষ্ঠী জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। বিশ্বযুদ্ধে ইউনিয়ন জ্যাকের হয়ে লড়তে গিয়ে যারা প্রাণ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অজস্র মুখ ভারতেরও। |
|
অলিম্পিকের মশালবাহী স্পিডবোট টেমস বেয়ে চালিয়ে আনলেন ডেভিড বেকহ্যাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাঙল-গড়ল ব্রিটিশ সমাজ-ইতিহাসের বহু ছবি। ড্যানিয়েল ‘বন্ড’ ক্রেগ
এবং রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ‘ডামি’রা লাফালেন কপ্টার থেকে। ছবি: উৎপল সরকার |
লন্ডনে শেষ বার অলিম্পিকের আসর বসেছিল বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তো! ১৯৪৮ সাল! সে বার সেনা ব্যারাকেই গড়তে হয়েছিল গেমস ভিলেজ! চূড়ান্ত টানাটানির বাজারে খেলোয়াড়দের বলা হয়েছিল, নিজেদের তোয়ালেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে!
২০১২-র লন্ডন রাজকোষেও সম্পদ বাড়ন্ত! কিন্তু মাঝের দশকগুলোয় ব্রিটেন যে কতটা বদলে গিয়েছে, তারই স্মারক হয়ে রইল কালকের অনুষ্ঠান! সাম্রাজ্য নেই, উপনিবেশ নেই, সামরিক শৌর্য নেই, সাংস্কৃতিক উন্নাসিকতাও বাঁচিয়ে রাখার জো নেই! সেই বাস্তবতাটা স্বীকার করে নিয়েই নিজেকে হাজির করল লন্ডন! ইতিহাসকে স্মরণ করল, অতীতচারিতায় ডুবল না। ক্রিকেট আর ফুটবলের জন্মদাত্রী ব্রিটেন নিজের নায়কদের নিয়েও অতিরিক্ত সময় ব্যয় করল না! স্পিডবোট চালিয়ে আনা ডেভিড বেকহ্যাম, পিটার প্যান থেকে পাঠরতা জে কে রোওলিং, রানির সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ড্যানিয়েল ক্রেগ বাড়াবাড়ি নেই কাউকে নিয়েই!
এই পরিমিতিই ব্রিটিশ রসবোধের অভিজ্ঞান। সেই রসবোধই আগাগোড়া কাজে লাগাল অলিম্পিক স্টেডিয়াম। সঙ্গে রইল অমোঘ মন্ত্র, “বি নট অ্যাফ্রেড; দ্য আইজল ইজ ফুল অফ নয়েজেস...।”
তাতেই জিতলেন ড্যানি, জিতল লন্ডন! |
|
|
|
|
|