নেতাজির প্রশ্ন: ‘কবে কাজ শুরু করতে পারবে?’ ঝটিতি জবাব, ‘আগামিকাল।’ লক্ষ্মী স্বামীনাথন সহগলের কথা লিখছেন
কৃষ্ণা বসু |
সাল ১৯৪৫, সময় শীতকাল। দিল্লিতে লালকেল্লায় বিচার চলছে আজাদ হিন্দ ফৌজের তিন বীর সেনানীর। তাঁদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশ উত্তাল। দেশের সেই সন্ধিক্ষণে বালিকা বয়সের জন্মদিনে অনেক উপহার পেলাম। তাতে ছিল বাবার দেওয়া চরকা, কেউ দিয়েছেন সুভাষচন্দ্রের লেখা ‘তরুণের স্বপ্ন’, কেউ বা দিলীপকুমার রায়ের ‘আমার বন্ধু সুভাষ’। কিন্তু যে উপহার আমার মন কেড়ে নিল তা একটি ছোট ক্যালেন্ডার, তাতে সৈনিকের বেশে এক সপ্রতিভ তরুণীর মুখ জ্বলজ্বল করছে। নীচে লেখা লক্ষ্মী স্বামীনাথন। তখনই তিনি কিংবদন্তি। গত সোমবার সেই সংগ্রামী নারীর জীবনাবসান হল।
কোনও এক সময়ে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে নেমে তিনি আমাদের একান্ত আপনজন হয়ে পড়েছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবন ও আদর্শ সংরক্ষণের কাজে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর সদস্য হিসাবে লক্ষ্মী সহগলের ভূমিকা ছিল ঐকান্তিক। বলতেন, এ সব তথ্য সংগ্রহ করে রাখা জরুরি, আমরা যে এক দিন দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলাম, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা প্রেরণা হবে।
কাজের ফাঁকে বা পারিবারিক বৈঠকে সে সব দিনের কথা লক্ষ্মীর মুখে শোনা এক অভিজ্ঞতা। এক দিন গুনগুন করে গাইছিলেন দুর্গম গিরি, কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে। তুমি নজরুলের বাংলা গান কোথায় শিখলে? আমার বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে হেসে বললেন, কেন, নেতাজি শিখিয়েছিলেন। আমাদের রানি বাহিনীর কয়েক জন মেয়েকে এক লাইন করে গান গেয়ে নিজে শিখিয়েছিলেন।
নেতাজি যখন এসে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন, তখন লক্ষ্মী সেখানে তরুণী চিকিৎসক। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগের সভাপতি ইয়েলাপ্পা বলে পাঠালেন, নেতাজি ডেকে পাঠিয়েছেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী গঠনের ভার দিতে চান। ৯ জুলাই এক বিশাল সমাবেশে ‘টোটাল মোবিলাইজেশন’-এর ডাক দিয়েছেন নেতাজি। মুক্তি সংগ্রামে সার্বিক যোগদান, মেয়েদের বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। তিন দিন পরে গঠিত হল নারী বাহিনী। নেতাজি দেখতে আসবেন খবর পেয়ে জনা কুড়ি মেয়েকে তিন দিন ধরে গার্ড অব অনার দেওয়ার তালিম দিলেন লক্ষ্মী। শাড়ির আঁচল কোমরে জড়ানো, হাতে মস্ত ভারী রাইফেল, গার্ড অব অনার দিলেন। |
নেত্রী। রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট, আজাদ হিন্দ ফৌজ |
নেতাজি এই প্রথম প্রচেষ্টায় খুশি হয়েছিলেন। তবে আলাদা করে ডেকে লক্ষ্মীকে তিনি বলেছিলেন, সব দিক ভেবে কাজে হাত দিতে। এটা কিন্তু লোকদেখানো ব্যাপার নয়, বর্মার জঙ্গলে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কবে কাজ শুরু করতে পারবে? প্রশ্নের ঝটিতি জবাব, আগামিকাল থেকে।
নেতাজি নিজের মুখে তেমন কোনও নির্দেশ দেননি, কিন্তু মেয়েরা চুল কেটে ফেলেন। প্রাণ দেওয়ার জন্য তৈরি, চুল তো কোন ছার। দীর্ঘ কেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে আহুতি হল। মেয়েদের ইউনিফর্ম হল জোধপুর ব্রিচেস, বুশ শার্ট, কালো বকলস দেওয়া জুতো। মিলিটারি ট্রেনিং শুরু হল। জাপানি সংস্কৃতিতে মেয়েরা গৃহিণী অথবা মনোরঞ্জনকারিণী। প্রথম দিকে ট্রেনিংয়ের গুলিবারুদ দিতে তাঁদের বিশেষ আপত্তি। পরে অবশ্য মেয়েদের সাহস ও আন্তরিকতায় জাপানি অফিসারেরা মুগ্ধ হন।
ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়ার পথে সাবমেরিনে বসে মেয়েদের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর বাপারে তাঁর বক্তব্য নেতাজি ডিকটেশন দিলেন আবিদ হাসানকে। সাবমেরিন জলের উপর সামান্য ভেসে উঠেছিল। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের চোখ পড়ে যাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম। বিপদসংকেতের মধ্যে দুলতে দুলতে সাবমেরিন জলার তলায় ডুবছে। আবিদের কানে এল নেতাজির শান্ত কণ্ঠস্বর, আবিদ, আমি একটা লাইন দু’বার বললাম, তুমি লেখোনি। কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলেন তিনি।
কী সেই বক্তব্য যা তিনি সিঙ্গাপুরে নেমেই মেয়েদের কাছে তুলে ধরলেন? আবিদ হাসান নোট নিয়েছিলেন। মেয়েদের হতে হবে বীরাঙ্গনা। মৃত্যু ও অসম্মানের মধ্যে ভারতীয় নারী বেছে নিয়েছে মৃত্যু। কিন্তু এখন চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। যেমন হয়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই পুণ্য নামে হবে রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট। সিপাহি বিদ্রোহকে নেতাজি বলতেন, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। দেশের শেষ স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েদের সামরিক বাহিনীর অধিনেত্রী হলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সহগল)। স্বাধীন ভারত সরকারের নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকারের প্রথম মহিলা মন্ত্রীও তিনি।
লক্ষ্মী আমাদের বলতেন, তোমরা যে কী সব নারীস্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে বড়াই করো, নেতাজির মতো ‘ফেমিনিস্ট’ আমি আর দেখিনি। কথাটা সত্যি। তিনি লিখেছিলেন, রন্ধন আর সন্তান উৎপাদন নারীর একমাত্র জীবন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর চেয়েছিলেন বাসন্তী দেবী বাংলার হাল ধরবেন। তিনি রাজি না-হওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আপনি কর্তব্যে অবহেলা করেছেন।
ইম্ফল রণাঙ্গনে যেতে চায় মেয়েরা। তাদের সিঙ্গাপুর থেকে এগিয়ে আনা হল রেঙ্গুনে। বাছাই করা এক দলকে পাঠানো হল অগ্রবর্তী ঘাঁটি মেমিওতে। নেতৃত্বে আছেন লক্ষ্মী। মেমিও হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শনে এলেন নেতাজি। সে রাতেই চাঁদের আলোয় প্রবল বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল তাদের ব্যারাক। মেমিওর কাছে কালাউতে ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন লক্ষ্মী। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে মেয়েদের দাপট দেখে ইংরেজরা স্তম্ভিত।
স্বাধীন ভারতে লক্ষ্মী সহগল জনসেবায় যুক্ত ছিলেন। ছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতেও। যে বামপন্থী দল তিনি বেছে নিলেন, তারা গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন বা নেতাজির ‘আজাদ হিন্দ আন্দোলন’ সমর্থন করেনি। বিস্মিত জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি অকপটে বলতেন, নেতাজি শিখিয়েছিলেন সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করবে। তিনি যখন সেই কাজের বৃহত্তর পরিধি খুঁজছেন তখন যে রাজনৈতিক সুযোগ আসে তিনি তা মন থেকে গ্রহণ করেন। এ তাঁর ব্যক্তগত অভিরুচি। কিন্তু লক্ষ্মীর জীবনে নেতাজির প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। সকল আজাদ হিন্দ সৈনিকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ নেতাজির সান্নিধ্যে কাটানো দুটি বছর তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়েছিলেন লক্ষ্মী সহগল ২০০২ সালে। পার্লামেন্টের ৬৩ নম্বর ঘরে সহ-সাংসদদের সঙ্গে ভোটারদের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে সে বার অত্যন্ত উপযুক্ত দুই প্রার্থী বিজ্ঞানী কালাম আর বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী সহগল। সাংসদেরা বলাবলি করছিলেন, অঙ্কের হিসেবে পরাজয় অবধারিত জেনেও লক্ষ্মী সহগলের কি দাঁড়ানো উচিত হল? হতে পারতেন প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। পরাজিত হলেও মহিলাদের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা কি একটু খুলে দিয়ে গেলেন না? পরবর্তী নির্বাচন সেই রকমই বলে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে পথিকৃৎ এই নারীর ছিল সহজাত সৈনিকের স্পিরিট। যে কোনও যুদ্ধে নির্ভয়। কর্নেল লক্ষ্মী সহগলের জন্য রইল আমাদের অভিবাদন। জয়হিন্দ। |