২৩ জানুয়ারি, ১৯৫০। মধ্যরাত্রের কিয়ৎক্ষণ পরে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেখিলেন, একটি চিঠি আসিয়াছে। জরুরি বার্তা। প্রেরকের নাম বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ। মাত্র কয়েক দিন পরেই নবীন প্রজাতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিবে ভারত। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ লইবেন রাজেন্দ্র প্রসাদ। সহসা, নিশাকালে তাঁহারই একটি পত্র আসিয়া উপস্থিত। রাজেন্দ্র প্রসাদ দ্বিধায়। চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী, তদানীন্তন সেনাধ্যক্ষ জেনারেল কারিয়াপ্পার পরামর্শ, ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বিশিষ্ট পরিধান থাকা প্রয়োজন। সুতরাং, শপথগ্রহণের সময় রাষ্ট্রপতি আচকান ও পাজামা পরিধান করিতে পারেন। তাঁহার কাঁধ হইতে ঝুলিতে পারে একটি গৈরিক বা নীল আলঙ্কারিক পাড়, পরিভাষায় ‘স্যাশ’, গাত্রে শোভিত একটি অশোকচক্র! রাজেন্দ্র প্রসাদ লিখিয়াছেন, আচকান-পাজামা তিনি নিয়মিতই পরিধান করিয়া থাকেন, কোনও সমস্যা নাই, কিন্তু ‘চক্র’-যুক্ত ‘স্যাশ’? জওহরলাল নেহরুর পোশাক-ভাবনা, লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর মতোই, সুচারু ছিল! অননুকরণীয় সৌজন্যে নেহরু জানাইলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের বিশিষ্ট পরিধান বাঞ্ছনীয়, কিন্তু, উপযুক্ত বিবেচনা ব্যতিরেকে, সহসা একটি রংদার পাড়-জাতীয় বস্তু পরিধান করিবার অর্থ হয় না। একই যুক্তিতে তিনি অশোকচক্র রাখিবারও পক্ষপাতী নহেন। অতঃপর, শপথগ্রহণের দিন রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর পরিধেয় হইতে স-চক্র ‘স্যাশ’টি বাদ পড়িল। |
কাহিনি-অন্তে বার্তা ইহাই, রাজপোশাকের কথা অমৃতসমান। রাজ-অঙ্গে কী উঠিল, তাহা লইয়া হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত হইতে তাত্ত্বিক-পণ্ডিত, কাহারও আগ্রহের অভাব নাই। কেহ চাহেন গল্প, কেহ বিশ্লেষণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, বাকিংহাম প্রাসাদে রানি মেরি ঈষৎ ‘ফ্যাশন’-দুরস্ত হইতে চাহিলেন। আক্ষরিকই ‘ঈষৎ’। রানি চাহিয়াছিলেন, রাজকীয় ‘স্কার্ট’-এর প্রান্তটি ভূমির মাত্র কয়েক ইঞ্চি উপরে থাকুক। শঙ্কিত রানি প্রথমে নিজের বস্ত্রটি হ্রস্ব করিতে চাহিলেন না। তাঁহার আদেশক্রমে রানির পার্শ্বচরী, পরিভাষায় ‘লেডি-ইন-ওয়েটিং’-এর স্কার্ট নিরীক্ষামূলক ভাবে ছোট হইল। রানি ব্যাকুল, রাজা পঞ্চম জর্জের প্রতিক্রিয়া কী হয়! দুঃখের বিষয়, নৃপতির বিবেচনায় স্কার্ট-এর ঝুল রাজ-মহিমার পক্ষে যথেষ্ট খাটো প্রতিপন্ন হইল। মহারানির ফ্যাশন-বিলাস জমিতে পারিল না। অমিত রায় থাকিলে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতেন, ‘ফ্যাশন’ হইল মুখোশ, ‘স্টাইল’ মুখশ্রী তাই ‘ফ্যাশন’ লইয়া এত হৃদয়বেদনা কেন? ‘ডায়ানা’ নাম্নী জনৈক রাজকুমারীও তখন ভবিষ্যতের গর্ভে, ফলে বাকিংহাম প্রাসাদের রাজ-গরিমা কী রূপে ‘ফ্যাশন’-এর আক্রমণে ছত্রখান হইয়া যায়, তাহাও ধরাধামে দেখা যায় নাই। বস্তুত, রাজপোশাকের প্রতিটি বুননে যে অ-লৌকিক দীপ্তি, তাহার প্রতি জনতার আগ্রহ সীমাহীন। আকবর বাদশার পোশাক কেনই বা হরিপদ কেরানির তুল্য হইবে? আম-দরবারে যাহা কিছু শাসক হইতে শাসিত-কে পৃথক করিয়া দেয়, পোশাক তাহার অন্যতম। ইতিহাস অবশ্য ইহাও বলিবে যে, রাজা কখনও কখনও চীরবাস-ও পরিধান করিয়া থাকেন। কিন্তু, তাহা একটি কাহিনির শেষ। অন্য কাহিনির শুরু। |