সবার উপরে টিপছাপ সত্য
৮৫৮।
কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে এল, ভারত অচিরে রানির সাম্রাজ্য হবে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের তরুণ অফিসার উইলিয়াম জেমস হার্শেল এলেন বাংলায়। হুগলি অঞ্চলে পোস্টিং হল তাঁর। কাজপাগলা মানুষ। নিজের মতো ভাবতেও পারেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জমিজমা, বাণিজ্যের দরদস্তুর, কনট্র্যাক্ট-টেন্ডার করতে গিয়ে একটা নতুন রেওয়াজ চালু করলেন। কনট্র্যাক্ট পেপারের শেষে ‘নেটিভ’দের দস্তখতের পাশাপাশি, আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যাপারটাকে ডবল নিশ্চিত করা। শুরুটায় অবশ্য কেবল আঙুল নয়, গোটা হাতের ছাপ নেওয়া হত। রাজ্যধর কোনাই নামে এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর হাতের পাঞ্জার ছাপ পড়ল প্রথম কাগজে, আর শুরু হল এক নতুন ইতিহাস। ফিংগারপ্রিন্ট-এর ইতিহাস। মনে করা হয়ে থাকে, দিনটা ছিল এই ২৮ জুলাই।
প্রথমটায় উইলিয়াম হার্শেল হাতের বা আঙুলের ছাপ চালু করেছিলেন নিতান্ত ব্যবসায়িক গরজে। সাহেবের বক্তব্য ছিল, এখানকার লোকগুলো সই দিতে চায় না, অনেকে তো পারেই না। তাই প্রথমে হাতে, পরের দিকে ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার আঙুলে কালি ছুঁইয়ে দাও ছাপ, কাগজে, কন্ট্র্যাক্ট পাকা হল। এমনকী ভারতীয়দের কুসংস্কার-ধোয়া বিশ্বাসে নাকি, কন্ট্র্যাক্ট পেপারের সঙ্গে শরীরের অঙ্গবিশেষের এই ‘পার্সোনাল টাচ’ পুরো ব্যাপারটাকে একটা বাড়তি নিশ্চয়তা দিত।
জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে। আঙুলের ছাপও কিছু কম যায় না। বছরের পর বছর আঙুলছাপ জমিয়ে জমিয়ে রীতিমত একটা ‘ফিংগারপ্রিন্ট ব্যাংক’ই তৈরি করে ফেললেন উইলিয়ম। তার মধ্যে নিজের বিভিন্ন বয়সের হাতের ছাপও রাখলেন। এবং সেই বিপুল সম্ভার খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সাহেব ক্রমে বুঝতে পারলেন, কী আশ্চর্য, এত বছরে পাল্টায়নি, পাল্টায় না ফিংগারপ্রিন্টের বিন্যাস। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ফ্রিকশন রিজ প্যাটার্ন’। আঙুলের ডগায় অল্প স্ফীত চামড়ার অংশটিতে এই নকশা থাকে। হার্শেল বুঝতে পারেন, তিনি আসলে ধরে ফেলেছেন দুটি আশ্চর্য সত্য:
১) যে কোনও মানুষের ফ্রিকশন রিজ প্যাটার্ন তার জীবদ্দশায় কখনও পাল্টায় না।
২) প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে প্যাটার্নটি একেবারে ইউনিক স্বতন্ত্র। সারা জগতে দু’টো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাদের আঙুলের ছাপ অবিকল এক রকম। প্রকৃতির এ এক আজব কুদরতি!
দুটি সত্যকে মেলালে খুঁজে পাওয়া যায় এক অসামান্য চাবিকাঠি। ফিংগারপ্রিন্ট প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্য প্রত্যেক ব্যক্তির থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় এবং সেই পরিচিতি ব্যক্তির জীবন জুড়ে কখনও বদলায় না। মাতৃগর্ভে থাকার তিন মাস বয়সে শিশুর হাতের আঙুলে ‘ফ্রিকশন রিজ’-এর সৃষ্টি হয়। এবং, মাতৃগর্ভে থাকা ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’-এরও কিন্তু ফিংগারপ্রিন্ট কখনও এক রকম হবে না। ফিংগারপ্রিন্ট-এর বেসিক প্যাটার্ন-এর সাদৃশ্য কোনও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দেখা যেতেই পারে, বা বংশানুক্রমে বাহিত হতে পারে। এক পরিবারের হয়তো সবারই আঙুলের ডগার রেখার আঁকিবুঁকিটা ‘লুপ’ টাইপের। কিন্তু হুবহু এক? কখনও নয়। সবার উপরে ফিংগারপ্রিন্ট সত্য, তাহার উপরে নাই।
অপরিবর্তনীয়তা আর স্বাতন্ত্র্য এই দুই ধর্ম আঙুলছাপকে অসামান্য এক গুরুত্ব এনে দিল বিভিন্ন বিদ্যায়; জীববিজ্ঞান, অ্যানাটমি, অপরাধবিজ্ঞান আর ফরেনসিক সায়েন্সের দিগন্তকে ছড়িয়ে দিল বহু দূর। উইলিয়াম হার্শেলের আগে পরে ফিংগারপ্রিন্ট নিয়ে বহু চর্চা ও গবেষণা হয়েছে, কিন্তু আঙুলের ছাপ কাজে লাগিয়ে মানুষকে চিহ্নিত করার ধারণাটি উদ্ভাবনের গৌরবমুকুট পেয়েছেন তিনিই। আর তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ভারতবর্ষের নাম। বাংলারও।
১৮৯৭ সালে কলকাতায় গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল স্থির করে, ক্রিমিনাল রেকর্ড সংগ্রহের ক্ষেত্রে ফিংগারপ্রিন্ট ব্যবহার করা উচিত। সেই সূত্রেই কলকাতায় গড়ে ওঠে ক্যালকাটা অ্যানথ্রোপোমেট্রিক ব্যুরো, পরবর্তী কালের ফিংগারপ্রিন্ট ব্যুরো। আমরা যথারীতি ভুলে গিয়েছি সেই সময়কার কলকাতায় দু’জন বাঙালি ফিংগারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞের নাম: আজিজুল হক এবং হেমচন্দ্র বোস। নানা ধরনের আঙুলছাপ কী ভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়, তার সূত্র নির্ধারণে এই দুই বাঙালি বিশারদের ভূমিকা অসামান্য। এঁদের সুপারভাইজার ছিলেন স্যর এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। একে ‘বস’, তায় সাহেব, বছরের পর বছর আঙুলছাপ জমিয়ে জমিয়ে রীতিমত একটা ‘ফিংগারপ্রিন্ট ব্যাংক’ই তৈরি করে ফেললেন উইলিয়ম। তার মধ্যে নিজের বিভিন্ন বয়সের হাতের ছাপও রাখলেন।
সূত্রের নাম হল ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’।
ফিংগারপ্রিন্ট থেকে জানা যেতে পারে অপরাধী পুরুষ, না মহিলা, তার আকার, উচ্চতা দেওয়ালে লেগে থাকা ফিংগারপ্রিন্ট উচ্চতার ধারণা দেয়। এমনকী আঙুলছাপে মিলতে পারে পেশার হদিশ।
কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কারদের হাত যেমন রুক্ষ হয় খুব, মিউজিশিয়ানদের আঙুলের ডগায় অনেক ক্ষেত্রেই চামড়াটা শক্ত, মোটা হয়ে গিয়ে ‘callus’ তৈরি করে। ফিংগারপ্রিন্ট-এ সে সবের প্রভাব থাকে। ফিংগারপ্রিন্ট-এর অনুপস্থিতিও গোয়েন্দাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেমন, কেউ সুইসাইড করেছে, কিন্তু সেখানে যদি ফিংগারপ্রিন্ট মুছে ফেলার কোনও চেষ্টা ধরে ফেলা যায়, বা কোনওই ফিংগারপ্রিন্ট না থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, কেসটা গণ্ডগোলের।
কোনও কোনও ধুরন্ধর অপরাধী আঙুলের ডগা অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে, বা প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে নেয়। একমাত্র এ ভাবেই ফিংগারপ্রিন্ট লুকোনো সম্ভব। সাধারণ কাটা-ছেঁড়া, পোড়ায় ফ্রিকশন রিজ-এর বেসিক প্যাটার্ন পাল্টায় না। তবে ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’ বলে একটা বিরল রোগ আছে, যার রোগীদের আঙুলের ডগার চামড়া একেবারে মসৃণ, ফিংগারপ্রিন্ট পড়ে না! এই রোগের আর একটা ইন্টারেস্টিং নাম আছে: ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’। কেন, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে! ২০১১ সাল অবধি গোটা বিশ্বে মাত্র চারটি পরিবার পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা এই রোগে ভুগছেন।
ফিংগারপ্রিন্ট-এর তুমুল ব্যবহার হয়েছে গোয়েন্দা গল্পে আর সিনেমায়। মার্ক টোয়েনই প্রথম সাহিত্যিক, যিনি তাঁর লেখায় ফিংগারপ্রিন্ট দিয়ে অপরাধের তদন্তের ব্যাপারটা ব্যবহার করেন (‘লাইফ অন দ্য মিসিসিপি’ আর ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব পুডিংহেড উইলসন’)। শার্লক হোমস ‘দ্য নরউড বিল্ডার’ গল্পে আসল অপরাধীকে ধরেন এই ফিংগারপ্রিন্ট-এর মাধ্যমেই। হলিউডি ক্রাইম থ্রিলারে তো আকছার এসেছে ফিংগারপ্রিন্ট-এর ব্যবহার। সে উইল স্মিথ-এর ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ হোক, কী হাল আমলের ‘ডার্ক নাইট’ (যেখানে ব্যাটম্যান দেওয়াল ভেঙে বের করা বুলেটের অংশ থেকে বের করে ভিলেন জোকারের ফিংগারপ্রিন্ট)। বলিউডি ‘কহানি’-র বিদ্যা বাগচীর নিজের ফিংগারপ্রিন্ট মুছে ফেলার দৃশ্যটাই বা ভুলি কী করে? আজকাল ডি এন এ প্রোফাইলিং করেও অপরাধীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। সে পদ্ধতির নাম ‘জেনেটিক ফিংগারপ্রিন্টিং’! টিপছাপ বলে হেয় করবেন না।

রাইট? না, লেফট



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.