ব্যাগ গুছিয়ে...
ডাকছে নাগজিরা
চৌধুরীদা বললেন, ‘‘আরে, বোসোই না। ওদের তুমি চেনো। ছেলেটা তো বরাবরই বনপাগলা। বছরখানেক হল বিয়ে করেছে। বৌকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে বাঘ দেখাতে চায়। তাই আমার কাছে সুলুকসন্ধান করতে আসছে। সাহায্য করাটা তো আমাদের কর্তব্য।’’
বসে গেলাম। নির্ঝর এসেই চৌধুরীদাকে একটা প্রণাম ঠুকল, অনুশীলাও তাই করল। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘‘দাদা তুমিও আছ, এ তো সোনায় সোহাগা...। একটু বাঘ দেখার সাধ হয়েছে, তাই চৌধুরীদার কাছে এসেছি।’’
চৌধুরীদা বললেন, ‘‘সাধ নয়, বলো আহ্লাদ। নতুন বৌকে বাঘ দেখিয়ে বাহাদুরি কামাবে, তাই তো? বাঘ দেখা কি অতই সস্তা নাকি হে...’’
নির্ঝর হাঁউমাউ করে বলল, ‘‘সে তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কানহা, বান্ধবগড় কি রনথম্ভোরের যা সব প্যাকেজ তাতে ভালমতো একটা ট্রিপ করলে পরের দু’-তিন মাস আমাকে হেঁটে হেঁটে অফিস করতে হবে। সবে বিয়ে করেছি যে তাই নয়, বিয়ের পরে পরেই সিকিমে একটা হনিমুন ট্রিপও মেরে দিয়েছি। পকেটে ভাটার টান। অনুশীলা কোনও দিন জঙ্গলে যায়নি, তাই এত সব প্ল্যানিং। আর বনে গেলে বাঘ দেখার চান্স না নিলে হয়?’’
বললাম, ‘‘দাদা, তাড়োবা-আন্ধেরি বা পেঞ্চ-এ পাঠান না...টাইগার সাইটিং তো মোটামুটি নিশ্চিত।’’
‘‘না না’’, চৌধুরীদা মাথা নাড়লেন, ‘‘আর একটু কাছাকাছির মধ্যে বরং নাগজিরাই যাক। খরচটাও কম হবে, আর সামান্য চেষ্টা-চরিত্তির করলে সেখানে বাঘের দেখা মিলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যদিও মনে ভেবো না খরচের ব্যাপারে আমি খুব কিছু মাথা ঘামাচ্ছি, তবু নাগজিরায় ট্যুরিজমের দিকটা এখনও সে রকম পকেট-কাটা নয়। তবে হ্যাঁ, গাড়িতে ভালই খরচ আছে। জঙ্গলে পায়ে হেঁটে ঘোরা বেআইনি। তোমরা মোটে দু’জন তো গাড়ি, গাইড এই সব খরচ কারও সঙ্গে ভাগ হবে না।’’
নির্ঝর বলল, “একটু খুলে বলুন। কোথা দিয়ে যাব, থাকব কোথায়, খাব কী আর দেখব কী?’’
‘‘যাবে ট্রেনে চেপে গোন্ডিয়া, কলকাতা থেকে গেলে নাগপুরের কিছুটা আগে। গোন্ডিয়া থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে চোরখামারা চেকগেট হয়ে ঢুকে সোজা নাগজিরা। গোন্ডিয়া থেকে চোরখামারা ৪৮ কিলোমিটার। আর একটা গেট আছে সাকোলির কাছে পিতেঝরি গেট, সেটা গোন্ডিয়া থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। নাগজিরা অভয়ারণ্যের প্রায় মাঝামাঝি নাগজিরা লেক। এই লেক ঘিরেই বনবিভাগের কিছু নানা মাপের নানা ধাঁচের কটেজ আর অফিস। চোরখামারা দিয়ে ঢুকলে নাগজিরা লেক ৯ আর পিতেঝরি থেকে ১১ কিলোমিটার। কাজেই চোরখামারা হয়ে গেলে দূরত্ব কিছুটা কম পড়বে। এ বারে থাকবে কোথায়, তাই তো?’’
“হ্যাঁ, তবে একটু ধীরে ধীরে বলুন, লিখতে লিখতে যাই। আপনার মতো কম্পিউটার মেমারি তো নয়...’’
‘‘চেষ্টা করবে নাগজিরা লেকের ধারে মহারাষ্ট্র বনবিভাগের কটেজ বা হলিডে হোমে জায়গা পেতে। ভারতের খুব কম বাঘ-বনেই এখনও ভিতরে ট্যুরিস্টদের থাকতে দেয়। এই সুযোগ ছেড়ো না। যদিও কারেন্ট নেই, থাকার বন্দোবস্তও নিতান্ত সাধারণ। খাবার জায়গা বলতে একটা মাত্র ক্যান্টিন, সেখানেও ডিম ছাড়া সবই নিরামিষ। জরুরি জিনিসপত্র সব সঙ্গে নিতে হবে, ভিতরে আধখানা দোকান পর্যন্ত নেই। মশারি পেলেও মশা তাড়ানোর ক্রিম, দরকারি ওষুধ, মোমবাতি, দেশলাই, টর্চ, বিস্কুট, চানাচুর, কৌটো করে নারকেল নাড়ু এ সব সঙ্গে রাখা ভাল। কী মা, পারবে না কষ্ট করে ক’টা দিন কাটাতে?’’
অনুশীলা ঘাড় হেলিয়ে বলল, “খুব পারব। তা ছাড়া এই তো সিকিমে কত আরামে থেকে খেয়ে ঘুরে এলাম। জঙ্গলে থাকব, আর এটুকু করব না!”
“তবে আর কী! নেহাত যদি জঙ্গলের ভিতরে থাকার জায়গা বুক করতে না পারো, তা হলে চোরখামারা গেটের পাশে দু’-তিনটে বেসরকারি থাকার জায়গা হয়েছে এখন। শুনেছি সাকোলি গেটের পাশেও একটা তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা আছে। বাইরে থাকলে অবশ্য কারেন্টটা পাবে। কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে থাকার মজাটা সেখানে নেই। রোজ নির্দিষ্ট সময়ে জঙ্গলে ঢুকবে আর বেরোবে। জঙ্গলের ভিতরে থাকলেও বনের পথ ধরে সাফারির সময়টা বাঁধা। সকালে সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ১০টা আর বিকেলে ৩টে থেকে সাড়ে ৬টা। একটা খুব জরুরি কথা মনে রেখো, নাগজিরার জঙ্গল প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। ভিতরে থাকলেও বেরিয়ে আসতে হবে। কাজেই টানা ভিতরে থাকতে চাইলে বুকিং পাবে বড়জোর শুক্র থেকে বুধবার পর্যন্ত। বর্ষার সময়ে জঙ্গল বন্ধ থাকে ১৫ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর। পয়লা অক্টোবর খোলে। গাইড নেওয়া কিন্তু বাধ্যতামূলক। তবে তাঁরা স্থানীয় ছেলে, ভাল ভাবে প্রশিক্ষিত। ওদের সঙ্গে সম্পর্কটা জমিয়ে নিও। তোমায় বাঘ-ভাল্লুক দেখানোর ন্যূনতম সুযোগ থাকলেও ওরা তার জন্য প্রাণপাত করবে। আর তোমার ‘দেখব কী’ প্রশ্নটার সব থেকে আশাবাদী উত্তর হল: বাঘ।”
‘‘দেখব বলছেন?’’ নির্ঝরের চোখ চকচক করে উঠল। “আমি কিন্তু শেষ বাঘ দেখেছি সেই পাঁচ বছর আগে, বান্ধবগড়ে।’’
‘‘দ্যাখো না নতুন বৌয়ের ভাগ্যে কী আছে। বিগিনার্স লাক। তবে নাগজিরায় বাঘ দেখার সম্ভাবনা যথেষ্টই বেশি। আর কী কী দেখবে জানতে চাও না?’’
‘‘হ্যাঁ দাদা, বলুন। শুনব বলেই তো এলাম।”
‘‘তবে শোনো, নাগজিরার জঙ্গল এক কথায় অপরূপা। মাইলের পর মাইল বিছিয়ে থাকা শালবন, ঘাসবন আর বাঁশবনে স্বপ্নের প্রশান্তি। কোথাও বা ঝোপেঝাড়ে ঢাকা বিস্তীর্ণ সমতল, কোথাও নিবিড় বন, ছোট-বড় টিলা, নির্জন জলাশয় আর অরণ্যের বুক চিরে এ দিক সে দিক বয়ে যাওয়া রুক্ষ পাথুরে নালা। জঙ্গলে ডজন দেড়েক বাঘ ছাড়াও ভাল্লুক, চিতাবাঘ, বুনো কুকুর, বনবেড়াল, বেজি, ভাম, চিতল, নীলগাই, গাউর, সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, খরগোশ, হনুমান, বুনো শুয়োর এ সবই আছে। আছে সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, কাচপোকা, মাকড়সা, পিঁপড়ে আর ঘুম ভাঙানো পাখির ঝাঁক। দেখবে জঙ্গলের গায়ে শীতকুয়াশার আলসেমি আর ভোরের আলোর শব্দহীন সম্পাত। নাগজিরা লেকের জলে বনান্তের বর্ণিল প্রচ্ছায়া। দেখবে পড়ন্ত সূর্যের উদ্ভাসে ঝিকিয়ে ওঠা মাকড়সার মায়াজাল, চিতলের কচি শিং-এ রুপোলি ভেলভেটের রূপ-তবক, নিস্তরঙ্গ জলতলে চকিতে আঘাত হেনে উড়ে যাওয়া মাছরাঙার মাছ ধরার ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য। বাঘ যদি দেখা না-ও দেয়, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হবে বলে তো মনে হয় না!”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.