অসমে দাঙ্গার দাপট অব্যাহত। কার্ফু, সেনা টহল, বাহিনীর ফ্ল্যাগ-মার্চ, দেখা-মাত্র গুলির নির্দেশ কিছুই দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত করিতে পারে নাই। প্রতিদিনই নূতন-নূতন স্থানে মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইতেছে। নিরাপত্তা ও ত্রাণের খোঁজে ভিটেমাটি ত্যাগ করিয়া উদ্বাস্তু শিবিরে পাড়ি দেওয়া দুর্গতের সংখ্যা দুই লক্ষ ছাড়াইয়াছে। পরিস্থিতি খতাইয়া দেখিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আজ উপদ্রুত এলাকায় আসিতেছেন। সম্ভবত তাঁহার সফরের সিদ্ধান্ত জানিয়াই মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও তড়িঘড়ি কোকরাঝাড় সফর করিলেন। এত দিন কিন্তু তিনি সেখানে যাওয়ার সময় পান নাই। বস্তুত, দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং দুর্গতদের মনে ভরসা ফিরাইবার কাজে কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী গগৈ-এর সরকার নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ। অসমের কংগ্রেস নেতারাও এই ব্যর্থতার নিন্দায় মুখর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও রাজ্য সরকারের তৎপরতার অভাবের সমালোচনা করিয়াছে।
দাঙ্গার কারণ বড়োল্যান্ড বলিয়া পরিচিত নিম্ন অসমের বড়ো-অধ্যুষিত জেলাগুলির জনবিন্যাসের কাঠামোর বিপর্যয়কর পরিবর্তন। চা-বাগানের শ্রমিকের কাজে সাঁওতাল পরগনা হইতে ব্রিটিশের আমদানি করা জনজাতীয়রা এবং বাংলাদেশ হইতে কৃষিজীবী ভাগ্যান্বেষীদের ধারাবাহিক অনুপ্রবেশ এই জেলাগুলির আদি বাসিন্দা বড়ো জনজাতিকে কার্যত সংখ্যালঘু করিয়া তুলিয়াছে। বড়োদের জমিজমা, ভিটেমাটি গ্রাস করিয়া লইতেছে ওই অনুপ্রবেশকারীরা। কর্মসংস্থানের অপরিসর বাজারও ক্রমাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বড়োদের জন্য যৎপরোনাস্তি সঙ্কুচিত। এই অবস্থায় আগ্রাসক বনাম তাহার শিকারদের মধ্যে যে ধরনের অনাস্থা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক, কোকরাঝাড়, ধুবুরি, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জেলায় বহু কাল হইতেই তাহা লালিত হইয়াছে। দাঙ্গা কেবল সেই ঘৃণার বিস্ফোরণ। যত দিন এই ঘৃণার প্রশমন না হইবে, বিপদ কাটিবে না। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যেই অসম পড়িবে, মুসলিম লিগ নেতৃত্ব এমন খোয়াব দেখিতেন। দেশভাগের সময় সেই আশা অপূর্ণ থাকিয়া গেলেও অসমকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ভাবার মানসিকতা ধারাবাহিক ছিল। তাই অসমের বিভিন্ন জেলায়, ব্রহ্মপুত্র নদের সহসা জাগিয়া ওঠা চরে বাংলাভাষী মুসলিম কৃষিজীবীদের বসত গড়িয়া ওঠার প্রক্রিয়া অব্যাহত। কেবল কৃষিজীবীরাই নয়, মাটি কাটা, রিকশ চালানো, জঙ্গল সাফ করিবার মতো সস্তা শ্রমিকের জোগানও ওই অনুপ্রবেশকারীদের বস্তি হইতেই মেলে। অসমের জনবিন্যাসের কাঠামো দ্রুত পরিবর্তিত হয়। তাহার প্রতিবাদে শুরু হয় ‘বিদেশি বিতাড়ন’ আন্দোলন।
সেই আন্দোলন চরম হিংসাত্মক আকার লইলে সরকার নড়িয়া বসে, বিদেশি চিহ্নিতকরণ ও বহিষ্কারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। কিন্তু সংখ্যালঘু তোষণের সংকীর্ণ রাজনৈতিক তাগিদে যাবতীয় সরকারি সদিচ্ছা ভাসিয়া যায়। সেই তাগিদ আজও সমান প্রবল। বিশেষত রাজ্যের শাসক কংগ্রেস দলের তরফে বিদেশি অনুপ্রবেশের সমস্যাটি অমীমাংসিত রাখিয়া দেওয়ার পিছনে আর কোনও উদ্দেশ্য খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন বড়ো জনজাতির বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির সামনে এই প্রশাসন অসহায়। এ ধরনের অসহায়তা হইতেই কিন্তু মরিয়া প্রত্যাঘাতের তাড়না সৃষ্টি হয়। সমগ্র সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আবশ্যক। সেই দায় কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুই তরফেরই। |