আবার অচলাবস্থার আবাহন। আবার একটি পরিবহণ ধর্মঘট। নামে পরিবহণ ধর্মঘট হইলেও কার্যকারিতায় শেষ পর্যন্ত ইহা সামগ্রিক বন্ধ-এরই চেহারা লইতে পারে, যদি ধর্মঘট সফল হয়। ধর্মঘটের সাফল্যের হারে পশ্চিমবঙ্গের যে সুনাম, তাহাতে শঙ্কা হয়, মঙ্গলবার আরও একটি বাংলা বন্ধ-এর জন্যই রাজ্য প্রস্তুত হইতেছে। একটি নয়, আসলে দুই-দুইটি ধর্মঘট এ দিন পালিত হইবে। একটি ধর্মঘট পরিবহণ মালিকদের, জ্বালানির বর্ধমান মূল্যের সহিত সঙ্গতি রাখিয়া ভাড়া বাড়াইবার দাবিতে। অন্যটি পরিবহণ-কর্মীদের, পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবদ্ধি কমাইবার দাবিতে। শেষোক্তটি একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক, বিরোধী দল সি পি আই এমের শ্রমিক ইউনিট সিটু’র ডাকা। পরিবহণ-কর্মীদের আন্দোলন ও স্বার্থের সহিত পরিবহণ মালিকদের আন্দোলন ও স্বার্থ এ ভাবে মিলিয়া যাওয়ার সমাপতনটি পরিহাসময়। তবে এ রাজ্যের রাজনীতিতে এমন পরিহাস অস্বাভাবিক নয়।
উল্লেখযোগ্য হইল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় ধর্মঘট-বিরোধী অবস্থানের পুনর্ঘোষণা। কোনও ক্রমেই ভাড়া বাড়াইতে না দিবার যে জেদে মুখ্যমন্ত্রী অবিচল, তাহা বিতর্কের অতীত নয়। কেননা এই আপাত-জনতোষক জেদ অর্থনীতির অনিবার্য বাস্তবতাকে অস্বীকার করিতে চায়। কিন্তু প্রতিবাদ ও আন্দোলনের নামে কথায়-কথায় জনজীবন বিপর্যস্ত করিয়া রাজ্যের যাবতীয় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ স্তব্ধ করিয়া দিবার মধ্যে যে জঙ্গি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ট্রেড ইউনিয়নবাজি রহিয়াছে, তাহার কঠোর বিরোধিতায় মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সিটু নেতৃত্ব (যাহার সহিত শ্রমিকদের চেয়েও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বামপন্থী রাজ্য-নেতাদের সম্পর্ক বেশি) সরকারের অবস্থানে লড়াইয়ের সম্ভাব্যতায় ‘খুশি’। তাঁহাদের ধারণা, ইহার ফলে হতাশ দলীয় কর্মীরা আন্দোলনের আগুনে গা সেঁকিবার প্রেরণা পাইবেন। কিন্তু এই মনোভাবের মধ্যে যে কর্মনাশা সংস্কৃতির আনুগত্য ফুটিয়া বাহির হয়, রাজ্য সরকার তাহার মূলেই আঘাত করিতে চায়। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি হুমকি দিয়াছেন, ধর্মঘটে যোগ দিলে সরকারি পরিবহণ কর্মীদের যেমন বেতন কাটা যাইবে, বাস-মালিকদের তেমনই পারমিট খারিজ হইবে, আর সরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলিতে ভর্তুকি প্রত্যাহৃত হইবে। কড়া হুমকি। সরকার ইহা কার্যকর করিতে পারিবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে মুখ্যমন্ত্রী যে বন্ধ-অবরোধের নেতিবাচক রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী এবং কর্মসংস্কৃতি প্রবর্তনের পক্ষপাতী, এই বার্তাটি রাজ্যবাসীর কাছে পৌঁছাইয়া গিয়াছে।
অতঃপর রাজ্যবাসী কী করেন, ধর্মঘটের অজুহাতে খিল আঁটিয়া ঘরে বসিয়া আর একটি ছুটির দিন উপভোগ করেন, নাকি সরকারি যানবাহনের উপর ভরসা করিয়া কিঞ্চিৎ ঝুঁকি লইয়াও কাজে বাহির হন, তাহার উপর নির্ভর করিবে রাজ্যের কর্মসংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের সাফল্য-ব্যর্থতা। জনসাধারণের উপর বন্ধ, অবরোধ, ধর্মঘট চাপাইয়া দিবার একতরফা অনুশীলন পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রতিবাদের অধিকারের সহিত এই সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নাই। নেতিবাচক আন্দোলন মারফত সংগঠিত প্রতিবাদ কাঙ্ক্ষিত দাবি আদায়ে কতটুকু সফল হয়, তাহা বিশদ জল্পনার বিষয়। মাঝখান হইতে রাজ্যের অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতি হইয়াছে, অসংখ্য কর্মদিবস নষ্ট হইয়াছে, গরিব মানুষের রুজিরুটি অনর্জিত থাকিয়াছে। লাভের মধ্যে আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়িয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুষ্টচক্র হইতে রাজ্যকে বাহির করিতে চাহিতেছেন। বঙ্গবাসীর উচিত, কালিদাসী আত্মঘাতে নিরত না হইয়া এ ব্যাপারে তাঁহাকে সহযোগিতা করা। |