পরিকাঠামো নেই, তবু সফল হল অস্ত্রোপচার |
অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসক বলেছিলেনঘণ্টা খানেক কোনও কথা না বলতে। গত দু’বছর যিনি বলতে পারেননি, তাঁর কাছে ওই ঘন্টাখনেকও ঢের বলে মনে হয়েছে।
চুপ করে থাকতে পারেননি বছর সাতান্নর দক্ষিণ দিনাজপুরের রবীন হেমব্রম। চিকিৎসকের কথা অগ্রাহ্য করে বলে ওঠেন, “ডাক্তারবাবু আমি আগের মত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারব তো?”
|
তারিক আনোয়ার।
ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত। |
প্রশ্নের উত্তর আর চিকিৎসককে দিতে হয়নি। রোগীর পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন ডোমকল মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক তারিক আনোয়ার। এ দিকে গলা দিয়ে আগের মতই স্বর ফুটে ওঠায় নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রবীনবাবু। এত দিন পরে বাবার কথা বলার শক্তি ফিরে আসায় বাকরুদ্ধ তাঁর ছেলে রাজেন হেমব্রমও। গলার স্বরও আগের মতোই স্বাভাবিক। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “উনি চিকিৎসক, না ম্যাজিশিয়ান!” যেখানে সাধারণত সামান্য জটিল অস্ত্রোপচারের প্রশ্ন উঠলেই বড় হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়ার ‘রেওয়াজ’ রয়েছে, সেখানে তারিক আনোয়ার প্রায় কোনও পরিকাঠামো ছাড়াই থাইরোপ্লাস্টির মতো অস্ত্রোপচার করে অবাক করে দিয়েছেন গ্রামের মানুষকে। ওই অস্ত্রোপচার কতটা জটিল ও সময় সাপেক্ষ তা নিয়ে অবশ্য ডোমকলের মানুষের কোনও মাথা ব্যথা নেই। তাঁরা ভাবছেন রেফার করা তো দূরের কথা, নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ করে এই অস্ত্রোপচার করে এই চিকিৎসক এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। অস্ত্রোপচারের যাবতীয় সরঞ্জাম কেনা থেকে সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট (যা দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়েছে গলার বাম দিকের ল্যারিংগ্যাল নার্ভ), তাও নিজের টাকায় কিনেছেন ওই চিকিৎসক। ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারীর কথায়, “ওই ঘটনা আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। চিকিৎসকরা যাতে এ ভাবে এগিয়ে আসেন, তার জন্য আমরা তাঁদের উৎসাহিত করব।”রাজ্যের স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপতী এ ব্যাপারে বলেন, “ডোমকল মহকুমা হাসপাতালের পরিকাঠামোয় কিছু কিছু ঘাটতি এখনও রয়ে গিয়েছে। তবে চিকিৎসকেরা আমাদের কাছে কোনও যন্ত্র চেয়ে পাঠালে আমরা অবশ্যই তার ব্যবস্থা করব। এখানে চিকিৎসক নিজেই টাকা দিয়ে যন্ত্র কিনে অস্ত্রোপচার করেছেন, এটা প্রশংসনীয়। তবে আমরা সবসময়েই পরিকাঠামোর ঘটতি মেটাতে তৈরি।”
তারিক আনোয়ারের কথায়, “থাইরোপ্লাস্টি অপারেশন জটিল হলেও কঠিন নয়। এর আগে এসএসকেএম হাসপাতালে আমি ওই অপারেশনের সহযোগী চিকিৎসক হিসেবে ছিলাম।”
রাজেনবাবুর কথায়, “বিঘা তিনেক জমির ফসল থেকে সংসার চলে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে জমানো অর্থও সব শেষ হয়ে যায়। সেই সময়ে মালদহের এক বন্ধুর কাছ থেকে চিকিৎসক তারিক আনোয়ারের কথা জানতে পারি। এর পরেই বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সোজা কলকাতায় তাঁর বাড়িতে হাজির হই। তিনিই পরামর্শ দেন ডোমকল মহকুমা হাসপাতালে আসার। বাকি যা প্রয়োজন সবটাই তিনি করেছেন। এমন কী একটি দামি পরীক্ষাও উনি নিজের পয়সায় করিয়েছেন।”
তবে প্রথম বার নয়, এর আগেও বেশ কিছু গরিব অসহায় রোগীর অস্ত্রোপচার হাসপাতালে করিয়েছেন ওই চিকিৎসক। এজন্য সপ্তাহ দুয়েক আগে নিজের অর্থে কেনা এন্ড্রোসকোপি যন্ত্র কলকাতা থেকে এনে নেত্রনালীর অস্ত্রোপচারও করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমাদের হাসপাতালে ব্লাড ব্যাঙ্ক ও আধুনিক যন্ত্র না থাকায় অনেক রোগীকে বহরমপুর বা কলকাতা পাঠাতে হচ্ছে। এগুলির উন্নতি হলে রেফারেল কেস আটকানো যাবে। তবে একজন প্রৌঢ়ের মুখে কথা ফোটাতে পেরে আমি খুশি।” হাসপাতালের সুপার অরিন্দম পাল বলেন, “সরকারি হাসপাতালের মর্যাদা বাড়িয়েছেন ওই চিকিৎসক।” ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সম্পাদক রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “ওই চিকিৎসক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। পরিকাঠামোর দোহায় না দিয়ে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে পরিকাঠামোহীন মহকুমা হাসপাতালেও যে জটিল অস্ত্রোপচার করা সম্ভব তার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তিনি।” |