সেতুর তলা থেকে চিৎকার করেছেন এক মহিলা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ, পোশাক। সামনে দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে লাল-কালো টি-শার্ট ও নস্যিরঙা প্যান্ট পরা এক যুবক। তাকে দেখিয়ে মহিলা বলছেন, ‘‘ধরুন, ওকে ধরুন। ও আমার ইজ্জত নিয়েছে।”
পথচলতি মানুষ দেখেছেন। কিন্তু এগিয়ে আসেননি কেউ। এমনকী, পুলিশও মুখ ফিরিয়েছে বলে অভিযোগ।
বস্তুত বুধবার ভোরে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের কাছে ‘নিগৃহীতা’ মহিলাটি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে যে ‘অভিজ্ঞতা’র সাক্ষী হয়েছেন, তাতে যেন পার্ক স্ট্রিট, কালীঘাট বা কালিকাপুর-কাণ্ডেরই ছায়া। যে অভিজ্ঞতা বলছে, কোনও অত্যাচারিতা প্রতিকারের আশায় থানায় গেলে তাঁর পুলিশি ‘অনীহা ও হেনস্থা’র শিকার হওয়ার সম্ভাবনা এখনও ষোলো আনা। তা সে খাস কলকাতার ‘অভিজাত’ পার্ক স্ট্রিট হোক, কিংবা হাওড়ার জগাছার মতো ‘আধা শহর’ এলাকা। এ ক্ষেত্রে ‘নিষ্ক্রিয়তা’র আঙুল সেই জগাছা থানারই দিকে, যার আওতাধীন সাঁতরাগাছি সেতুর রাস্তায় এ দিন আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই মহিলা।
কোনা এক্সপ্রেসওয়ের উপরে, হাওড়া হোমসের গা-ঘেঁষা মাটি-মোরাম মেশানো রাস্তাটি সাঁতরাগাছি স্টেশনে গিয়েছে। সেতুর বাঁয়ে সাঁতরাগাছি ঝিল, ঝিলের অন্য প্রান্তে রেল লাইন। জায়গাটা সুনসান। বছর দুয়েক আগে ঝিল থেকে চারটে কাটা হাত উদ্ধার হওয়ার পরে সন্ধে নামলে স্থানীয়
মানুষ ও দিকটা এড়িয়ে চলেন। তাঁদের বক্তব্য, রাত বাড়লে পুরো তল্লাট দুষ্কৃতীদের কব্জায় চলে যায়। আর এমনই তাদের দাপট যে, পুলিশও ধারে-কাছে ঘেঁষে না।
এমনই জায়গা দিয়ে এ দিন ভোরে রোজকার মতো চ্যাটার্জিহাটে কাজে যাচ্ছিলেন বাঁকড়ার বাসিন্দা ওই মহিলা। বাড়ি বাড়ি রান্না করেন তিনি, স্বামী থাকেন অন্যত্র। বছর আটত্রিশের বধূটি জানিয়েছেন, ভোর পাঁচটা নাগাদ তিনি যখন সাঁতরাগাছি সেতু পেরিয়ে নামার মুখে, এক যুবক তাঁর উপরে চড়াও হয়। তাঁকে টেনে নীচের ঝোপে যায়। বাধা দিতে গেলে প্রচণ্ড মারধর করে, তাঁর নাক-মুখ ফেটে রক্ত বার হতে থাকে। এবং সে তাঁকে ধর্ষণ করে বলে মহিলার অভিযোগ। “ছেলেটা যখন পালিয়ে যাচ্ছে, আমি কোনও মতে সেতুর কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে লোক ডাকতে থাকি।” জানাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু দুষ্কৃতীকে তাড়া করা তো দূর, রক্তাক্ত এক মহিলাকে দেখেও পথচলতি কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। মহিলা জানান, তিনি সেতুতে উঠে হাত জোড় করে গাড়ি থামাতেও চেয়েছিলেন। কেউ থামেনি। শেষে এক পুলিশকর্মীকে হেঁটে আসতে দেখে তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি তাঁকে ‘বাড়ি গিয়ে ডাক্তার দেখানো’র পরামর্শ দিয়ে চলে যান বলে অভিযোগ মহিলার।
এখানেই অবশ্য হেনস্থার শেষ হয়নি। যেমন?
এ দিন হাওড়া হাসপাতালের দোতলায় ফিমেল ওয়ার্ডে শুয়ে মহিলা জানান, কোথাও সাহায্য না-পেয়ে তিনি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোন ঘটনাস্থলের তিন কিলোমিটার দূরে জগাছা থানায়। তখন সকাল ছ’টা। ওঁর কথায়, “আমার শাড়ি-ব্লাউজ রক্তে ভেজা দেখেও ডিউটি অফিসার নির্বিকার রইলেন! চিকিৎসার ব্যবস্থা তো নয়ই, সব শোনার পরে ধর্ষণের অভিযোগও নিতে চাইলেন না! বাড়ি ফিরে গেলাম।”
বাড়ির লোক অ্যাম্বুল্যান্সে চড়িয়ে তাঁকে আবার থানায় নিয়ে যান। পরে ওঁকে ভর্তি করা হয় হাওড়া জেলা হাসপাতালে। দ্বিতীয় বার থানায় গিয়ে কি অভিযোগ লেখাতে পারলেন?
হাসপাতালে চত্বরে দাঁড়িয়ে মহিলার বোনের আক্ষেপ, “দিদিকে নিয়ে ফের জগাছা থানায় গিয়ে যখন ধর্ষণের নালিশ লেখাতে চাইলাম, ডিউটি অফিসার শুধু একটা ডায়েরি (জেনারেল ডায়েরি, সংক্ষেপে জিডি) করে ছেড়ে দিলেন!”
এ দিন হাওড়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মহিলা নাকে-মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বেডে শুয়ে। মুখে-গলায় রক্তের ছোপ। ডান হাতটা মুচড়ে গিয়েছে। তাঁর দাবি, “পুলিশকে বারবার বললাম, ধর্ষণ করা হয়েছে। শুনলই না! পরে বাড়ির লোক চাপ দেওয়ায় একটা শুধু ডায়েরি করল।” দুপুরে অবশ্য লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এফআইআর নেয়। ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষার জন্যও হাসপাতালকে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশকর্তারা।
কিন্তু থানা কেন প্রথমেই অভিযোগ নিল না? আর দ্বিতীয় বারেও কেন স্রেফ একটা জেনারেল ডায়েরি করে ছেড়ে দিল?
হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সদর) নিশাদ পারভেজ বলেন, “এটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে দুপুরে লিখিত অভিযোগ পেয়ে ধর্ষণের মামলা রুজু হয়েছে। অভিযুক্তের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”
|