সামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি চেয়েছিল মিশর। কী পেল? শরিয়তি শাসনের পথনির্দেশিকা?
না কি, অন্য পথে চলতে পারবেন মহম্মদ মুর্সি? আলোচনা করছেন
সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী |
মিশরে যে মানুষেরা স্বৈরতন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, কট্টরপন্থী ইসলামি রীতিনীতি পালনই কি তাঁদের নতুন ভবিতব্য? বহুকষ্টার্জিত রাজনৈতিক পালাবদল কি তালিবানি শাসনের সূচনা করল? রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কোয়ার-এ (বা স্বাধীনতা চক) বছর দেড়েক আগে থেকে যে বিপুলসংখ্যক মিশরীয় দিনের পর দিন জমায়েত হয়ে ‘পরিবর্তন’-এর দাবিতে সরব হয়েছিলেন, এই সব প্রশ্ন যেমন তাঁদের অনেকের, তেমনই এই প্রশ্ন মিশরের প্রতিবেশী দেশগুলির মানুষের। এই প্রশ্ন অন্যদেরও।
জুন মাসের শেষ দিনটিতে যখন প্রথা ভেঙে সেই তাহরির স্কোয়ারেই অগণিত দেশবাসীকে সাক্ষী রেখে মহম্মদ মুর্সি মিশরের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন, প্রশ্ন তখন থেকেই। হয়তো বা আরও আগে থেকে। সাংবাদিকের ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে যে, অত্যুৎসাহী এক ব্যক্তি মুর্সির হস্ত চুম্বন করেছেন! এ তো কেবল কোনও যুগপুরুষের জন্যই বরাদ্দ! তা হলে কি ইনি নতুন ফারাও?
অথচ, এই লোকটি ঠিক গামাল আবদেল নাসের অথবা এ কালের হোসনি মোবারকের মতো নয়। ‘আমি তোমাদেরই লোক’ এই বার্তা চটজলদি পৌঁছে দিতে তিনি তো দিব্যি নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে সমবেত মানুষকে দেখিয়েছেন, যেন বলতে চেয়েছেন: ঈশ্বর ছাড়া কাউকে আমি ভয় পাই না। এই লোকটি তো তাঁর পূর্বসূরিদের মতো সেনা-ঘনিষ্ঠও নন। তিনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে (আমেরিকাতেও) অধ্যাপনা করেছেন বহু বছর। সর্বোপরি, জনসাধারণের ভোটে জিতে তো প্রথম কেউ মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন!
হতে পারে যে, মুর্সি প্রথম দফায় ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ২৪.৭৮ শতাংশ, শেষ দফাতেও ৫১.৭৩ শতাংশ, সেই চূড়ান্ত পর্বে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আহমদ শফিক পেয়েছিলেন ৪৮.৩ শতাংশ ভোট। এটাও মনে রাখার মতো যে, প্রথম দফার ভোটে মুর্সির সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তফাত ছিল মাত্র ২ লক্ষ ৬০ হাজারের মতো ভোটের। প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষের দেশে তো এই সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য! তা ছাড়া প্রথম পর্যায়ে ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ৪৬ শতাংশ আর চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫২ শতাংশ। কিন্তু এই সব পরিসংখ্যান কি মুর্সির নির্বাচনকে খাটো করতে পারে? কখনওই নয়। |
তথাপি সংশয়। মুর্সি যে বিতর্কিত মুসলিম ব্রাদারহুড-ঘনিষ্ঠ ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রার্থী ছিলেন! তিনি শপথ নিতে না নিতেই দেশের নানা অংশে ইসলামি নীতি-পুলিশেরা সক্রিয় এমন অভিযোগও শোনা গেছে। আর সেই কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি তবে সেনা-আতঙ্কের জায়গা নেবে তালিবানি আতঙ্ক? মুর্সি সালাফি-ঘনিষ্ঠ, তাই শিয়া মুসলমানদের উদ্বেগ বেড়েছে। উদ্বেগ বেড়েছে সংখ্যালঘু কপ্টিক খ্রিস্টানদের। এবং, সাধারণ ভাবে মহিলাদের। উদ্বিগ্ন মিশরের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাও। এই তো সে দিন ‘প্রাচ্যের উডি অ্যালেন’ বলে পরিচিত এডেল ইমামকে তিন মাসের জন্য জেলে যেতে হল চলচ্চিত্রে ইসলামকে ‘হেয়’ করবার জন্য! কিন্তু সে তো মুর্সির কুর্সিতে আরোহণের আগে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার টমাস জেফারসন এক বার বলেছিলেন, জনগণ যদি শাসককে ভয় পায়, সেটা হল স্বৈরতন্ত্রের পদধ্বনি, আর সরকার জনসাধারণকে ভয় পেলে তা স্বাধীনতার ইঙ্গিতবাহী। মিশরের কিছু মানুষ যদি মুর্সির সরকারকে ভয় পান, তা হলে সেই ভয় দূর করবার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির নিজেরই। মুসলিম ব্রাদারহুডের ভূতপূর্ব সদস্য মুর্সিকে দ্রুত ‘রাষ্ট্রপতি মুর্সি’ হতে হবে। হতে হবে সমস্ত মিশরবাসীর রাষ্ট্রপতি। এটা তাঁর অজানাও নয়। তাই তাঁর মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, মুর্সি যখন পবিত্র রমজান মাসের শেষে তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, তখন তাতে স্থান হবে কপ্টিক খ্রিস্টান ও মহিলাদেরও। মোবারকের হাত থেকে নিস্তার পেতে যে তরুণতরুণী, খ্রিস্টান, সেকুলার, বামপন্থী এমনকী ট্রটস্কিপন্থীরা বার বার তাহরির স্কোয়ারে ভিড় জমিয়েছিলেন, তাঁরা এই ঘোষণায় নিশ্চিন্ত হয়েছেন এমন নয় অবশ্য।
আসলে, মুর্সির হাতে সময় কম। নাসের, আনোয়ার সাদাত বা হোসনি মোবারকের মতো প্রবল ব্যক্তিত্ব তাঁর নেই, দেশের সেনা-ছাউনিরও তেমন সমর্থন নেই তাঁর প্রতি, তাই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ এখন অনেক বড়। আর সেই চ্যালেঞ্জের কথা তাঁকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করাতেই বুঝি-বা শপথ গ্রহণের পর দিনই আত্মপ্রকাশ করেছে ‘মুর্সিমিটার ডট কম’ নামক এক ওয়েবসাইট। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে মুর্সি-উল্লিখিত ৬৪টি প্রতিশ্রুতির। এর কতগুলি রক্ষিত হয়, নজর সে দিকেই।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষ সংঘাতে যাবেন না, ইতিমধ্যেই মুর্সি তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। ৭৬ বছর বয়সি সেনাকর্তা তান্তোয়ি নিজেই যে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে চলেছেন, তা-ও স্পষ্ট। উল্লেখ্য, মুর্সি শেষ পর্যন্ত যাঁকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করেছেন, সেই হেশাম কান্ডিল মুসলিম ব্রাদারহুড-এর সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং, অন্য দিকে, বিদায়ী সেনা সরকারের জলসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। বস্তুত, মিশরীয় সেনা এত বছর ধরে যে ভাবে দেশের রাজনীতি ছাড়াও অর্থনীতি এবং সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, যে ভাবে নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করেছে, সেই প্রেক্ষিতে তার সঙ্গে এই মুহূর্তে সম্মুখসমরে যাওয়া মুর্সির পক্ষে কঠিন। অন্য দিকে, মিশরের উপরে প্রভাব বজায় রাখতে আগ্রহী ওয়াশিংটনও। রাজনৈতিক ইসলাম আমেরিকার অস্বস্তির কারণ। তাই রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাও মিশরের এই পর্বান্তরে সে দেশের সেনার ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। ইসলামি জুজু-র সাপেক্ষে মিশরের সেনাবাহিনী ইজরায়েলের কাছেও সম্ভবত বেশি নির্ভরযোগ্য। তাই দেশের প্রত্যক্ষ শাসন থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালেও মিশরের সেনাকর্তাদের প্রভাব এখনই কমবার কথা নয়।
লক্ষণীয়, এই মুহূর্তে মিশরের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা অত্যন্ত জরুরি। কেবল দেশে বার্ষিক আর্থিক বিকাশের হার দুই শতাংশের নীচে নয়, বেকার সমস্যাও অত্যন্ত তীব্র। বিশেষ করে এ বারের আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্বের মাত্রা খুবই উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বলে, অন্তত ৪০ শতাংশ মিশরবাসী দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বিভিন্ন কলকারখানার কর্মী এবং পরিবহণ কর্মীদের মজুরিবৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে। মুর্সি কিছু আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন, তবে এখনও তা নামমাত্র। তাঁর সামনে পথটা লম্বা। কিন্তু তা পাড়ি দিতে হবে দ্রুত। পারানির কড়ি জোগাড় করতে গেলে যে-সব দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার উপরে তাঁকে নির্ভর করতে হতে পারে, তাদের কাছে মুসলিম ব্রাদারহুডের চাইতেও দেশের সেনাবাহিনী বেশি নির্ভরযোগ্য। সৌদি আরব বা ইরানের মতো জ্বালানির বিপুল ভাণ্ডারও নেই মিশরে। অতএব, পেট চলাও দায়।
আরব দুনিয়াতে বসন্তের নাচন যে দেশটি থেকে শুরু হয়েছিল, সেই টিউনিসিয়াতেও ইসলামিরা ভোটে জয়ী হয়েছেন। অথচ সরকারি তরফে ঘোষণা হয়েছে, দেশ চালাতে শরিয়তি আইনকে পাথেয় করা হবে না। মহম্মদ মুর্সির মিশরও এই পথে হাঁটবে কি না তা বলবার সময় অবশ্য এখনও আসেনি।
|
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত |