এগারোটি পঞ্চবার্ষিক যোজনা সমাপ্ত হওয়ার পরেও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কার্যকর ভূমিকার অভাবে আমাদের দেশে মহিলারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হতে পারেননি। (‘আগে ‘না-পাওয়া’টা সমান হোক’, অন্বেষা দত্ত, ২৮-৪) পাশাপাশি অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে নারী সংহতির জন্য প্রগতিমুখী রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত জরুরি হলেও এর প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। স্বভাবতই মহিলাদের কর্মক্ষেত্রগত সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে এখন সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে সীমিত গণ্ডি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উপায় না-থাকায় এঁদের জীবনের দুর্দশা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাপ্য পারিশ্রমিক ও মর্যাদা সম্পর্কে অনবহিত থাকার পাশাপাশি অজ্ঞতা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও। আসলে দীর্ঘ দিন সরকারি অবহেলার কারণে হরেক সমস্যা ও সঙ্কটের সম্মুখীন ললনারা কর্মক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছেন।
ফোরাম অব উইমেন ইন পাবলিক সেক্টর-এর দেওয়া তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগে কর্মরত ২৫ লক্ষ কর্মচারীর ভিতর মহিলার সংখ্যা মাত্র দশ শতাংশ। বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে বুদ্ধি, মেধা ও জ্ঞানচর্চায় পুরুষের সমকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও পিতৃতান্ত্রিক সামন্ত মূল্যবোধের দরুন সরকারি চাকরিতেও মেয়েদের অনুপাত ছেলেদের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, সারা বিশ্বে শ্রমিক-কর্মচারীর শতকরা ৫৮ ভাগ ললনা হলেও মোট আয়ের ১৬ ভাগের বেশি পারিশ্রমিক এঁরা পান না। তা ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে বিবিধ সমস্যা ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় এঁদের। এ লজ্জা সমস্ত মনুষ্যজাতির। |
আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যের দরুন আমাদের দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা ছেলেদের পাশে নয়, অনেক পিছনে। শারীরতত্ত্ব অনুযায়ী নারী পুরুষের থেকে শক্তিশালী এবং কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার সংবিধানস্বীকৃত হলেও জনসংখ্যার অর্ধেকাংশকে অত্যন্ত সচেতন ভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। মনে ও মননে নারী শক্তিশালী হয়ে উন্নততর সমাজ গঠন করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করুক, বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে স্বমহিমায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করুক, সামন্ত ইচ্ছায় আছন্ন অবিবেকীরা তা চায় না। নারীপ্রগতি ও স্ত্রী-স্বাধীনতার নামে ক্ষমতাবানদের আসর সরগরম নিছক রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি তথা মুনাফা লোটার উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকড় গেড়ে বসা সত্ত্বেও তা নিরাময়ের পরিবর্তে উন্নাসিক আত্মতৃপ্ত রাষ্ট্রীয় কান্ডারিরা সব ঠিক ভান করে চোখ উল্টে বসে আছেন।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ও নারীমুখী চেতনার অভাবে সরকারি কর্মক্ষেত্রেও মহিলা সম্পর্কীয় নীতি-নির্ণয় ও পরিকাঠামো সৃষ্টি বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এ ক্ষেত্রে আইনের যৌক্তিকতা বিচারের অধিকার থেকেও অন্যায় ভাবে ললনাদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের নীল নকশার মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের শোষিত এবং সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত অর্ধাংশ বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে অদূর ভবিষ্যতে স্বমহিমায় অভিষিক্ত হবেন, এমন আশা একমাত্র মূঢ় জনেই করতে পারে।
অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বেতন-বৈষম্য, ন্যূনতম মজুরি না-দেওয়া, মজুরিতে তারতম্য ঘটানো, চাকরিক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, শ্রম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিধি কার্যকর না-করা, আই এল ও-র সিদ্ধান্ত সমূহ অগ্রাহ্য তথা অমান্য করা ইত্যাদি ব্যাপক বঞ্চনা ও বৈষম্য ঘটছে ললনার ক্ষেত্রে। বিভিন্ন সময়ে গৃহীত জোড়াতাপ্পি দেওয়া কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি সুপারিশগুলিতে গতানুগতিকতা ছাড়া সার্বিক ভাবে মহিলা সম্পর্কীয় আর্থিক ভাবনা-চিন্তা ও পরিকাঠামোগত সৃজনশীল কর্মসংস্থানের উল্লেখ না-থাকায় তা নারীর হতাশ অন্তরে আদৌ আশাব্যঞ্জক চিত্র তুলে ধরতে পারেনি। সরকারি চাকরিতেও মহিলারা নানা ধরনের অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। কর্মজীবনে একই পর্যায়ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক শর্তাবলি অদ্যাবধি বিদ্যমান। নিয়মিত বেতন ও প্রমোশন দেওয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদের যোগ্য বলে তাঁদের একদমই বিবেচনা করা হয় না। ব্যক্তিত্ব, কুশলতা ও সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ নারীজীবনে পরিশেষে নেমে আসে দিনগত পাপক্ষয়ের গ্লানি। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকারি বাজেটে কর্মরতাদের আয়কর নির্ধারণে কিছু ছাড় দেওয়ার বিনিময়ে এঁদের সমর্থনের জন্য প্রচ্ছন্ন দাবি জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অথর্মন্ত্রী। আসলে আমাদের দেশে মেয়েদের চাকরির বিষয়টিকে এখনও ভর্তুকির দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করা হয়। সামগ্রিক ঘটনাবলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ভারতে মাতৃজাতি কত অসহায় এবং এঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কত ভঙ্গুর।
সরকারি ক্ষেত্রে মহিলাদের কর্মবর্ধনের নামে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বিবিধ প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে কাজের সুষমা বৃদ্ধির প্রয়াস মাত্র। কারণ, স্পর্শকাতর এই সমস্যার এত সহজ সমাধান আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের পক্ষেও অসম্ভব। ক্ষমতাসীনদের সোনার কাঠির স্পর্শে চাকরির সম্ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া সম্ভব হলেও নারীর নবজীবন লাভের আশা সুদূর-পরাহত। তা ছাড়াও সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে বাস্তব আয়োজনের বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হওয়ায় কাজের কাজ এক চুলও এগোবে বলে বোধ হচ্ছে না। যে-যে অসাম্যের দরুন কর্মক্ষেত্রে একজন মেয়েকে একটি ছেলের সঙ্গে অসম পাঞ্জা কষতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা দূর না-করে অন্তঃসারশূন্য প্রস্তাবের মাধ্যমে তড়িঘড়ি ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিয়ে মৌলিক পরিবর্তনের চিন্তা নির্লজ্জ আত্মতুষ্টির সমপর্যায়ভুক্ত। সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও পশ্চাদপদ অংশের আর্থিক বঞ্চনা অবসানের জন্য একান্ত আবশ্যক : নারী-পুরুষ সমানুপাতিক হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, মহিলাদের অধিক কর্মসংস্থানের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা। সে ক্ষেত্রে এঁদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা অত্যাবশ্যক। বিদ্যালয় স্তর থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু থাকলে ঠিক সময়ে উপযুক্ত নারী-কর্মী জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি, অফিসের কাজের সঙ্গে পারিবারিক দায়দায়িত্ব সমান ভাবে পালন করতে হয় বলে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি। সেগুলি এই রকম: (ক) মাতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর করতে অযথা টালবাহানা বন্ধ করা। (খ) কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি ক্রেশের ব্যবস্থা করা। (গ) কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার পর্যাপ্ত আয়োজন করা। (ঘ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের একই জায়গায় বদলির বন্দোবস্ত করা। (ঙ) বড় শহরে সুলভ ও কার্যকর পরিবহণ ব্যবস্থা চালু করা।
আর্থিক নিরাপত্তা দিয়ে গতিশীল করতে সুসভ্য পরিবেশ তৈরির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞানভিত্তিক নারীকল্যাণমুখী সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না-করলে চিরন্তন দুঃস্বপ্ন ভেঙে বিনা আয়াসে ললনাদের নবজন্মের প্রগতিবাদী আশা কোনও দিনই বাস্তবায়িত হবে না।
মানসকুমার রায়চৌধুরী। কলকাতা-২৬ |