প্রবন্ধ ১...
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা

দেশের পূর্ব আর উত্তর-পূর্বে গ্রীষ্মকালের পর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তারই প্রসাদে হিমালয় পর্বত থেকে বরফ গলে নামা নদীরা যেমন, তেমনই অসংখ্য ছোট-মাঝারি নদী-নালা-ঝরনা বেয়ে সেই জল হু-হু করে সমতলের দিকে আসে। পাহাড়ের গা বেয়ে নদী-নালায় নেমে আসবার পথে সেই জল এই তরুণ পর্বত হিমালয়ের বিস্তার থেকে ধুয়ে আনে আলগা মাটি, শিলাচূর্ণ, প্রাচীন জঙ্গলের নীচে জমা হওয়া পচা পাতার স্তূপ ‘হিউমাস’। এই প্রতিটি উপাদানই নানান প্রাকৃতিক গুণে পূর্ণ। বরাবরই বর্ষাকালে নদী সেই জলমাটির সম্ভার নিয়ে প্রবল বেগে সমতল ক্ষেত্রের দিকে নামত। সমতলে পৌঁছে সেই সম্পদ উঠত কূল উপচে। বর্ষা-স্ফীত জল আর পলিমাটি ছড়িয়ে পড়ত ততখানি, যতখানি নদীর ‘ফ্লাড প্লেন’, যত দূর পর্যন্ত নদীর বন্যাজল ছড়িয়ে যাওয়ার কথা। এক সময়ে নাকি ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধুর বয়ে আনা পলিমাটির প্রকাণ্ড সম্ভার কোটি কোটি বছরে উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল তৈরি করেছে। দুই জলধারা অর্থাৎ দুই ‘অপ্’ বা অব্-এর মাঝখানের এই এলাকা তাই ‘দোয়াব’ নামে পরিচিত। এর উর্বরতার কথা দেশবিদিত। লোকে বলে ‘অন্ন’ শব্দ উচ্চারণ করলেই নাকি অন্ন ফলত এ মাটিতে।
এ দেশের মানুষরা, নানান রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও নিজেদের প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়মগুলিকে ব্যবহার করে উৎপাদন ও নিজেদের জীবনযাপনের জ্ঞানকে বিস্মৃত হননি। পূর্বভারতে যে প্রচুর বৃষ্টি পড়ে, সেই জলের প্রায় আশি ভাগ বর্ষিত হয় সাধারণত বর্ষার চার মাসের মধ্যে। বিশেষত শীত-গ্রীষ্মের চার মাস প্রায় বৃষ্টিবিহীন থাকে। বর্ষার জলস্ফীতির কারণে নদীগুলোতে বন্যা আসবে, বন্যার সঙ্গে পলিমাটি, বর্ষা-বন্যা-শুকনো দিনের এই চক্রটিকে ঘিরেই ভারতীয় কৃষির মূল চক্রটি আবর্তিত হয়েছে। খরিফ ও রবি নামে কৃষির যে দু’টি ভিন্ন মরসুম, তার নির্ধারক জলস্ফীতি ও বন্যা। খরিফের বীজ ফেলা হয় জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। সেই বীজের চারা বড় হতে হতে আষাঢ় শেষে বৃষ্টি নামত। কাদামাঠে ধানচারা তুলে বসানো হত। ধান জল বেশি খায়।
ধানে ফুল ও বীজ আসার সময়ের মধ্যে বন্যার জল আসত পলি নিয়ে। ফলে সার ও সেচ দু’টিই ঘটত প্রাকৃতিক নিয়মে। বেশি জল নিচু জমি, উঁচু জমি, কম জল-কম পলির জমি হিসেবে চাষ হত অসংখ্য রকম ধানের ভিন্ন ভিন্ন জাতি। এ ছাড়া ধানখেতে বন্যার সময়ে ভেসে আসত মাছের ডিম, কুচো মাছ, গুগলি, নানা রকম শাকপাতা এমনকী অন্য কিছু কিছু স্থানীয় শস্যদানা গুঁছলু, কুট্কু, শামা ইত্যাদি। সে হিসেবে পুরনো কৃষি পদ্ধতিতে ধানখেত স্বাভাবিক ভাবেই বহুফসলি ছিল। বন্যা তাই নদী-কিনারের মানুষদের কাছে সাবধান হওয়ার বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে বরণীয়ও ছিল। গঙ্গা এ দেশে সব নদীর নাম। বহু এলাকায় আষাঢ় মাসে নদীর ধারে ধারে গঙ্গাপুজো হত। যে মাটি পালন করে, তাকেই বহন করে আনে বর্ষাকালীন বন্যা, তাই সে পলিমাটি। নেপাল-হিমালয় হয়ে নেমে আসা যে সপ্তধারা কোশী নদী, পলির ভারে খাত পালটে পালটে যে সমস্ত উত্তর বিহারকে ‘সোনা ফলানো’ করে গড়ে তুলেছিল, সেখানকার গ্রামের মেয়ে-বউরা বর্ষার শুরুতে বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে কোশী নদীর ধারে যেত বন্যাকে বরণ করতে। গান গেয়ে তারা প্রার্থনা করত ‘মা, তুমি এসো। আমাদের ক্ষেত্রে এসো। খেতে ধানের মাটি পুকুরের মাছ দিয়ে যাও।’ কোশী নদীর সাম্প্রতিক প্রলয়বন্যার পর এ কথা যাঁদের কাছে অলীক মনে হবে, তাঁরা ডেহরি-অন-শোন স্টেশনের দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের কথা মনে করতে পারেন, উত্তর বিহারের খেতে উৎপন্ন ধান-আখ-তামাক থেকে শুরু করে হাজার রকম কৃষিসম্পদ ওয়াগনে তোলবার জন্যই ব্রিটিশ প্রশাসনকে ওই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাতে হয়েছিল।
চাষের অন্য প্রধান মরসুম রবিশস্যের বীজ ফেলা হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণে, যখন বন্যার শেষে জল নেমে যাবে কিন্তু মাঠে-মাঠে থাকবে সজল সরস মাটি। সরষে, ভুট্টা, নানা রকমের ডাল, রাগি, যব, জোয়ার, বাজরা, গম, আরও নানা রকম দানাশস্য, তৈলবীজ। গম ছাড়া যাদের কারওরই গোড়ায় সেচ লাগে না। বৃষ্টিজল ও বন্যার পলির চেয়ে বেশি কোনও সারও দরকার হয় না, বরং ডালের গাছগুলি নিজেরাই মাটির খুব ভাল সার।
এই ব্যবস্থায় বন্যা ছিল এ দেশের কৃষিকাজের অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি। পাঁচ-সাত হাজার বছর ধরে, যে জনগোষ্ঠী নিজের আশপাশের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে যত দূর সম্ভব অবিকৃত রেখে, সহজসাধ্য ভাবে ব্যবহারের কুশলতায় নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারে, তাদের কাছ থেকে সেই সব কৌশল শিখে নেওয়াই তো মনে হয় বড় সংখ্যক মানুষের চাহিদা পূরণ করেও প্রকৃতিকে যথাসাধ্য কম ক্ষতিগ্রস্ত করার উপায়। জনসংখ্যার খাদ্য-চাহিদা, উচ্চ ফলনশীল ব্যয়বহুল কৃষির অনিবার্যতা ইত্যাদি নিয়ে এত কথা এবং তার এত জবাব ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, আরও হবে নিশ্চয়ই, সে প্রশ্নে যাওয়ার জায়গা এখানে নয়। যতটা কাপড় আমার হাতে আছে, তার চেয়ে অনেক অনেক বড় মাপের জামা সেলাই করতে গেলে শেষ পর্যন্ত আধখোলা গায়েই শীত-গ্রীষ্ম কাটাতে হবে। কৃষির প্রশ্ন, সবাই মনে করেন, জামা গায়ে দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। এ বছর ইতিমধ্যেই অসম প্লাবিত। উত্তর বাংলাও অংশত। গাঙ্গেয় উপত্যকার চেয়েও বড় বিপদের মুখে রয়েছে রাঢ় বাংলা। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার প্রত্যেকটি নদী দু’পাশের মাঠের সমান হয়ে আছে। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতও সেখানে বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। যে বন্যা সম্পদস্বরূপ ছিল, তা আজ বিধ্বংসী বিপর্যয়। অসমের ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’-এর প্রশিক্ষণের জন্য কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে কাজের পরিকল্পনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা না দিলে আমাদের এই প্রাচীন বন্যাপ্রবণ রাজ্যে ‘ত্রাণ ব্যবস্থা’ হবে না।
কী করে এখানে এসে দাঁড়াল সমস্তটা?
কোচবিহারকে বলে দিঘির শহর। এ বার বর্ষার শুরুতেই ঘণ্টা তিনেকের টানা বৃষ্টিতে সে শহরের সব পথঘাট সারা দিনের জন্য অচল হয়ে যায়। জলের অপ্রতিরোধ্য নিয়ম নিচু দিকে গড়িয়ে যাওয়া। কলকাতাকে নিয়ে ভয় এ শহরের সমস্ত নিচু জায়গা, জলাজমি, পুকুর এমনকী তার সমুদ্রের দিকে যে স্বাভাবিক ঢাল, সব কিছু বুজিয়ে ফেলে হাইরাইজের যে স্পর্ধিত বৈভব, বর্ষায় নিকাশির উপায় কী হবে? গঙ্গার খাত শহরের বহু নিচু এলাকার চেয়ে উঁচু। শেষে বৃষ্টির জলে ডোবা থেকে শহরকে বাঁচানোর জন্য নতুন করে দিঘি-পুকুর খোঁড়ায় মন দিতে হবে না তো?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.