কোকরাঝাড় ছাড়তেই স্বস্তি ফিরল ট্রেনের কামরায়
খানেই গতকাল ট্রেনে থেকে নামিয়ে কোপানো হয়েছে দুই যুবককে। ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে বাড়িঘর। চলেছে গুলিও। সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেস শ্রীরামপুরের লাইনে থেমে যেতেই তাই আতঙ্ক চেপে বসল কামরা জুড়ে।
টানা দু’দিন অসহনীয় অবস্থায় কাটিয়েছেন সম্পর্কক্রান্তি, ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। অনেকেই, যে ভাবে পেরেছেন গুয়াহাটি যাওয়ার আশা ত্যাগ করে নিউ জলপাইগুড়ি ফিরে গিয়েছেন। যাঁদের দায় ছিল, মাটি কামড়ে পড়েছিলেন তাঁরাই। বুধবার বেলা তিনটে নাগাদ গুয়াহাটির দিকে প্রথম ট্রেন ছাড়ল সম্পর্কক্রান্তি। গোটা পথ জুড়ে যেখানেই ট্রেন থেমেছে, ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছেন যাত্রীরা। নামনি অসমে হাঙ্গামার জেরে তিন দিন ব্যাপী বিভ্রান্তি, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের সহযাত্রী হয়ে অবশেষে ট্রেন পৌঁছল গুয়াহাটি।
অসমের দিক থেকে আসা সংঘর্ষের আঁচ কাল রাত থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে বাড়ি ফিরছিলেন এক যুবক। ট্রেন থেমে গিয়েছে শামুকতলা রোডে। কামরাতেই ফোন এল ধুবুরিতে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কান্নায় ভেঙে পড়া তিনি তখন কোনওমতে বন্ধুদের ফোন করার চেষ্টা করছিলেন। দুর্বল নেটওয়ার্ক সেই ভরসাটুকুও কেড়ে নিয়েছে বারবার।
শেষ অবধি ফোন পেলেন। জানলেন বাবা-মা প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছেন। বারবিশার উদ্দেশে। আশ্বাস দিলেন, “একবার বাংলায় ঢুকে পড়ো। দেখ, কোনও ঝামেলা নেই।” কিন্তু, তারপরেই খবর এল, বারবিশা থেকে শ্রীরামপুর সর্বত্র ছড়িয়েছে হাঙ্গামার আগুন।
কোকরাঝাড়ে অগ্নিদগ্ধ, পরিত্যক্ত বাড়ি। বুধবার ট্রেন থেকে ছবিটি তুলেছেন রাজীবাক্ষ রক্ষিত।
পুলিশ বারবার জানাচ্ছে, গুজব ছড়াবেন না। কিন্তু, গতকাল রাতভর, নিউ আলিপুরদুয়ার, আলিপুরদুয়ার স্টেশনে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের ঘোষণা, ঘোষণা-বাতিল, দু’টি স্টেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সব গুজবকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। রাতে আলিপুরদুয়ারে বলা হয়েছিল যাঁরা গুয়াহাটি যাবেন, নেমে যান। যাঁরা কলকাতা ফেরত আসতে চান, কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠে বসুন। সেই ‘কলকাতাগামী’ কাঞ্চনজঙ্ঘায়, রাতভর গরমে ছটফট করা যাত্রীরা সকালে যখন আলিপুর দুয়ারে স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে বিক্ষোভ দেখাতে গেলেন, তখন অবাক ম্যানেজার বলছেন, “আমরা তো জানি, এটা খালি ট্রেন। নিউ আলিপুরদুয়ারেই এই ট্রেনের যাত্রা বাতিল করে খালি ট্রেন হিসাবে আলিপুরদুয়ারে পাঠানো হয়েছে।” যাত্রী বিক্ষোভের জেরে বেলা ১১টা নাগাদ স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতিকে অনুরোধ করে খাবারের ব্যবস্থা করে রেল কর্তৃপক্ষ। তারপরেও, গুয়াহাটিগামী ট্রেন কখন ছাড়বে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি কাটেনি অনেকক্ষণ।
বেলা ১২টা নাগাদ শোনা গেল, সেনা নেমেছে। তারা বড়োভূমি জুড়ে রেললাইনের দখল নিচ্ছে। রাজধানী কামাখ্যাগুড়ি থেকে ছাড়লে, আলিপুরদুয়ার থেকে একমাত্র সম্পর্কক্রান্তি গুয়াহাটির দিকে যেতে পারে। বেলা ২টোয়, গুয়াহাটির প্রধান অপারেটিং আধিকারিক এস মুখোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে, তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “চারিদিকে কার্ফু। কোনও ট্রেন চলার খবর নেই।” এর ১৫ মিনিটের মধ্যে আলিপুরদুয়ারে ঘোষণা হল, পৌনে তিনটে নাগাদ সম্পর্কক্রান্তি গুয়াহাটি রওনা হবে। সেই সঙ্গে বিলি করা হয় খিচুড়ি, জল। শিশুদের জন্য আসে দুধ ও ওষুধ।
যাত্রীদের সমস্বরে জয়ধ্বনির মধ্যে বেলা তিনটে নাগাদ অবশেষে গা-ঝাড়া দিয়ে নড়ে উঠল সম্পর্কক্রান্তি। ট্রেন শামুকতলা রোড, জোরাই ছাড়াবার পরেই, রেলকর্মীরা বলে দিলেন দরজার আশপাশে থাকবেন না। গুলি আসতে পারে। পাথর ছোড়া হতে পারে। তাঁরা জানান, গতকাল, বাংলা-অসম সীমানার শ্রীরামপুরে ট্রেনের কামরা থেকে নামিয়ে দুই যুবককে কোপানো হয়েছে। চলেছে গুলি। চিরাং ও ধুবুরিতে ফের হাঙ্গামার জেরে, এই দিন ১৩০০ জওয়ান উত্তেজনাপূর্ণ এলাকায় গিয়েছেন। আইজি (বিটিএডি) এস এন সিংহ বলেন, ‘‘কোকরাঝাড়ে ২২টি ও চিরাং-এ ১১টি দেহ পুলিশ পেয়েছে। আজ ভিতরের এলাকাগুলিতে পুলিশ ও আধা সেনা পাঠানো গিয়েছে। কোকরাঝাড়ের অবস্থা কিছুটা ভাল।”
কেন্দ্রীয় সরকার অতিরিক্ত ৪৮ কোম্পানি সিআরপি অসমে পাঠিয়েছে।
গত দু’দিনে ২৫টি ট্রেন বাতিল হয়েছে। আরও ২৫টি ট্রেন হয় থেমে রয়েছে, না হলে, অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আজ, কেন্দ্রীয় যুগ্ম স্বরাষ্ট্র সচিব শম্ভু সিংহ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল কোকরাঝাড় আসেন। পুলিশ ও উত্তর-পূর্ব রেলের সঙ্গে বৈঠকের পরে, নিউ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কামাখ্যাগুড়ি ও নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে আটকে থাকা প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীকে ধাপে ধাপে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আরপিএফ, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, অসম পুলিশ ও সিআরপি প্রহরায় প্রায় আড়াই হাজার যাত্রী নিয়ে রওনা হয় সম্পর্ক ক্রান্তি। শম্ভু সিংহ কোকরাঝাড়ে বলেন, “আশা করছি, দু’দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মানুষকে ত্রাস কাটিয়ে, গুজব ছড়ানো বন্ধ করে এগিয়ে আসতে হবে।”
আতঙ্কিত যাত্রীরা অবশ্য লাইনের আশপাশে কোথাও সেনা জওয়ানদের টিকিও খুঁজে পাননি। কেবল জোরাই, কামাখ্যাগুড়ি, শ্রীরামপুর, গোঁসাইগাঁও স্টেশনগুলিতে, ইনস্যাসধারী হাতে গোনা আরপিএফ। শ্রীরামপুর পার হতেই চোখে পড়ে একের পর এক ভাঙা, জ্বলে যাওয়া বাড়ি। জনমানবহীন বসতিএলাকার মাঝে মধ্যে অস্থায়ী সিআরপি শিবির। ইতস্তত জটলা যেন অবাক চোখে ট্রেনের স্পর্ধা দেখছে।
শ্রীরামপুর, গোসাইগাঁও--যেখানেই ঝোপ বা খেতের মধ্যে ট্রেনে থেমেছে, আতঙ্কিত যাত্রীরা আশপাশে নজর রেখে, জানালা থেকে মাথা সরিয়ে রেখেছেন। গতকাল গোসাইগাঁওতেই রাজধানীর উপরে হামলা হয়েছিল। মরা জয়া মা নদী পার হওয়ার পরে, দু’দিকে বাড়ির আগুন এখনও পুরোপুরি নেভেনি। চৌতারা পার করতেই চোখে পড়ল, রেললাইনের পাশে, পরিত্যক্ত রেলের ভাঙা ঘরেই ত্রাণ শিবির। সেখানে বেশিরভাগই শিশু। ট্রেনে থাকা দুই বড়ো যুবক আতঙ্কে মাথা গুঁজে বসে। তাঁদের পরিবারের কোনও খবর মেলেনি তিন দিন। এসি ২ কামরার লাইনম্যানও এক বড়ো যুবক। দরজা খুলে, ফকিরাগ্রামের বাইরের ছবি তুলতে যেতেই চিৎকার করে মানা করলেন।
সন্ধ্যা ৬টা ২০। কোকরাঝাড় পৌঁছল ট্রেন। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন সেই বড়ো লাইনম্যান। বাইরে সব শান্ত। এমন কী, শিথিল কার্ফুর সৌজন্যে বাচ্চাকাচ্চা সহ এক বড়ো মহিলাকেও স্টেশনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। মিনিট তিনেকের মধ্যে চলতে শুরু করল ট্রেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস কামরায়। পরবর্তী গন্তব্য নিউ বঙ্গাইগাঁও। ধুঁকতে থাকা সিগন্যালে ভর করে এক যাত্রী গুয়াহাটির বাড়িতে খবর দিচ্ছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর মতোই আসছি রে আজ। সামনে পিছনে কতরকম পুলিশ। আমরাই প্রথম গুয়াহাটি যাচ্ছি কি না!” এতক্ষণ বিনোদনের সমস্ত উপকরণ আতঙ্কের ঠেলায় বোবা হয়েছিল। রাজস্থান থেকে আসা এক যুবক হঠাৎ বলে উঠলেন, “বহত হো গয়া টেনশন্, টেনশন্’। রাজেশ খন্না মরনে কে বাদ পহলিবার ট্রেন মে সফর কর রহে হে। উনকো এক গানা ডেডিকেট করতা হু।” মোবাইলে বেজে উঠল, ‘মেরে স্বপ্নো কী রানি কব...।’
নেহাতই বেমানান পরিবেশে খাপছাড়া গান। তবু, সেটাই ৭২ ঘণ্টা বাদে, এই মুহূর্তের একমবোদ্বিতীয়ম স্বস্তিসূচক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.