গল্ফের চুড়োর লক্ষ্যে ‘একলা’ দৌড় বাঙালির
প্রায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া গল্ফ কোর্সে চলছে বাবা আর ছেলের ‘পাটিং’ যুদ্ধ। মানে ফুট দশেক দূরত্ব থেকে গল্ফের স্টিক অর্থাৎ ‘ক্লাব’ দিয়ে বল গর্তে ফেলে দেওয়া। কোনও দিন বাবা বলেন, “এই পাটটা করতে পারলে ব্রিটিশ ওপেন’’, কোনও দিন সেটা পাল্টে হয় ইউ এস ওপেন। কোনও দিন ছেলে জেতে ব্রিটিশ ওপেন, কোনও দিন বাবা। শুধু কিছুদিন অন্তর বদলে বদলে যায় শহর। কখনও পুণে, কখনও রুরকি, কখনও বা বিন্নাগুড়ি, সেকেন্দরাবাদ, হায়দরাবাদ। বদলে যায় গল্ফ কোর্সও।
বছর চারেকের স্টেফিকে টেনিসের অ-আ-ক-খ শেখাতে আইসক্রিমের টোপ ব্যবহার করতেন বাবা পিটার গ্রাফ। প্রতি বার নেটের ও পারে বলটা ঠিকঠাক পাঠাতে পারলে ছোট্ট স্টেফি জিতত একটা করে আইসক্রিম। নেটে উইকেটের উপর কয়েন সাজিয়ে সেটা জিতে নেওয়ার যে টোপ আচরেকর সচিনকে দিতেন, তা ভারতীয় খেলাধুলোয় লোকগাথার পর্যায়ে। গত রবিবার গল্ফের ইতিহাসে কুলীনতম ব্রিটিশ ওপেনে আবির্ভাবেই ৩১ নম্বর হয়ে পঁচিশ বছরের যে বাঙালি যুবক ভারতীয় খেলার দুনিয়াকে বিস্ময়তাড়িত করে দিয়েছেন, যাঁকে নিয়ে ব্রিটেনের ট্যাবলয়েডে লেখা হয়েছে, ‘ভারতীয় চমক’, সেই অনির্বাণ লাহিড়ির গল্ফের হাতেখড়ির কাহিনিটা একটু অন্য রকম। এখানে আইসক্রিম বা মুদ্রা নয়, টোপ বলতে ছিল স্বপ্ন। ব্রিটিশ ওপেন জেতার স্বপ্ন। “বাবার হাত ধরেই গল্ফে হাতেখড়ি। মনে আছে আলো পড়ে এলে বাবা আর আমি পাটিং গেম খেলতাম। কত বার যে ব্রিটিশ ওপেন বাবার বিরুদ্ধে জিতেছি। তার পর ৯৭-এ টিভিতে সরাসরি দেখলাম, টাইগার উডসের প্রথম মেজর জেতা। খুব ছোটবেলার ওই কাল্পনিক ব্রিটিশ ওপেন জয় আমাকে খুব টানত। এখন বুঝি, ছোটদের মনে বড় স্বপ্ন শুরু থেকে ঢুকিয়ে দেওয়াটা খেলাধুলোয় ভাল কিছুর জন্য খুব জরুরি,” নিজের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে মঙ্গলবার সকালে ফোনে বলছিলেন অনির্বাণ।
সোমবার মাঝরাতে দেশে ফিরেছেন, আগামী শনিবার পর্যন্ত তাঁর ডেরা হায়দরাবাদ। বেঙ্গালুরুর ছেলে হায়দরাবাদে কেন? “বাবা-মা হায়দরাবাদে থাকেন যে। এই সপ্তাহটা ছুটি কাটিয়ে শনিবার বেঙ্গালুরু ফিরব। রবিবার সকাল থেকে ফের কর্নাটক গল্ফ অ্যাসোসিয়েশনের কোর্সে।’’ শুধু গল্ফের জন্যই হায়দরাবাদে বাবা-মার নিরাপদ সান্নিধ্য ছেড়ে ১৭ বছর বয়স থেকে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা অনির্বাণ। কোচ বিজয় দিবেচা সে রকমই চেয়েছিলেন। “একেবারে একা থাকি। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিজেই সব করি। ওমলেট থেকে চিলি চিকেন, ফ্রায়েড রাইস, সব রান্না করতে পারি। আপনি এলে খাইয়েও দেব,” হাসতে হাসতে বলেই যোগ করেন, “আরে আমি আপাদমস্তক বাঙালি। কিন্তু ছোটবেলায় বাবার চাকরির জন্য দেশের সর্বত্র ঘুরেছি বলে অনেক ভাষায় কথা বলতে পারি। বিভিন্ন সংস্কৃতি দেখেছি। আমাদের পরিবারটা ডাক্তারদের পরিবার। ঠাকুর্দা ডাক্তার। দাদু, বাবাও তাই। আমিই শুধু ডাক্তার হলাম না!” শুনলে মনে হবে সাক্ষাৎকার কোথায়, হঠাৎ আলাপ হওয়া পাশের বাড়ির ছেলের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে।
বাবা কর্নেল তুষার লাহিড়ি সেনাবাহিনীর ডাক্তার। মা নবনীতা হায়দরাবাদের কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা। আধুনিক, স্বচ্ছ এবং রক্ষণশীলতা মুক্ত এক পরিবেশে অনির্বাণের বেড়ে ওঠা। যেখানে গোটা পরিবার ডাক্তার বলে ‘ডাক্তার হতেই হবে’ গোছের কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। “বেঙ্গালুরুতে থেকেই বি কম করেছি, ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। আই অ্যাম ফলোয়িং মাই ড্রিম। যেটা গল্ফ। কিন্তু সেটা করতে আমার বাবা-মা পাশে ছিলেন। কোনও দিন ‘এটা করতে হবে’ বা ‘ওটা করো’ বলেননি। স্কুলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি। কিন্তু ১১-১২ বছর বয়স থেকে গল্ফ কোর্স বেশি টানত,” স্বীকারোক্তি অনির্বাণের।
দাদু-দিদা সল্টলেকের সিকে ব্লকের বাসিন্দা। দাদু ব্রিগেডিয়ার ডাক্তার নিমাই সেনের কাছে খবর পেয়েই ১১ বছর বয়সে কলকাতার আরসিজিসি-তে অনির্বাণের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলতে আসা। ‘‘আরসিজিসি-তে এসে প্রথম বুঝি, আমার বয়সি ছেলেরাও গল্ফে ইন্টারেস্টেড। তার আগে আমি শুধু বাবা আর ওঁর আর্মির সহকর্মীদের সঙ্গে খেলেছিলাম। সেই অল ইন্ডিয়া টুর্নামেন্টে ৬ নম্বর হয়েছিলাম। আরসিজিসি-র টুর্নামেন্টটা খেলার পরেই গল্ফ নিয়ে সিরিয়াস হয়ে পড়ি,” বলছিলেন তিনি। আনন্দবাজারে তাঁকে নিয়ে জীব মিলখা সিংহ, জ্যোতি রণধাওয়া, চৌরাসিয়াদের দরাজ শংসাপত্রের কথা মঙ্গলবার সকালেই কলকাতা থেকে দাদুর ফোনে শুনেছেন। কিন্তু এ সবে উদাসীন লাগে তাঁকে। গড়পড়তা ক্রিকেটারসুলভ ‘আমি কী হনু রে’ ভাব একেবারেই নেই, বরং অল্প বয়সেই আশাতীত পরিণত দ্রাবিড়ের শহরের বাসিন্দা। না হলে কেন বলবেন, “এত জন গল্ফারের ভাল ভাল কথা শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু আমি মোটেই ভাবতে চাই না দারুণ কিছু করে ফেলেছি। বরং বলব, আমি খুশি যে ব্রিটিশ ওপেনের পরে আমি আরও একটু পরিণত গল্ফার। ছোটবেলার হিরো টাইগার উডসকে কাছ থেকে দেখলাম। দেখলাম আরও দুই আইডল বিজয় সিংহ ও জীবকে। এতগুলো বড় গল্ফারকে কাছ থেকে দেখা, কী ভাবে তারা এক একটা হোল নিয়ে ভাবছে, পাট কী ভাবে করছে, সব কিছু খুঁটিনাটি থেকেই শেখার চেষ্টা করেছি। এটাই বড় কথা, ৩১ নম্বর হওয়াটা নয়।”
খুব সহজ একটা জীবনদর্শনে বিশ্বাসী অনির্বাণ। ‘কিপ থিংস সিম্পল।’ জানাচ্ছেন, কেন ‘মেডিটেশন’ বা ধ্যান তাঁর খেলা তো বটেই, জীবনদর্শনটাই বদলে দিয়েছে। “আমি তিন বার মেডিটেশনের কোর্স করেছি। এটা শুধু গল্ফে নয়, আমার জীবনেও একটা ব্যালান্স এনে দিয়েছে। চার পাশের কোলাহল থেকে খুব সহজে আমি সুইচ অন, সুইচ অফ করতে পারি।” এই আত্মবিশ্বাসের ঠিক কতটা আরোপিত আর কতটা স্বাভাবিক, সেটা মাপতে ইচ্ছে করবেই। অনির্বাণের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা আরোপিত নয়। বরং তাঁর কথাবার্তায় আপাদমস্তক পেশাদার হওয়ার আঁচড়। বছরে ছ’মাস অন্তত বিদেশে থাকতে হয়। বলছিলেন, “আর পাঁচটা ইন্ডিভিজুয়াল স্পোর্টের চেয়েও গল্ফ আলাদা। টেনিস, ব্যাডমিন্টন বা বক্সিং যেমন রি-অ্যাক্টিভ স্পোর্ট। আপনার এক জন প্রতিপক্ষ আছে। সে আপনার মারা শটটায় কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করছে, সেই অনুযায়ী আপনি পরের শটটা খেলছেন। গল্ফ তা নয়। এটা অ্যাক্টিভ স্পোর্ট। একটা বল ক্লাব দিয়ে গর্তে ফেলা। পুরোটাই আপনার উপর। একটা স্থিতিশীল থাকা বলকে মারতে হচ্ছে এবং আপনিই আপনার প্রতিপক্ষ। এ খেলায় আপনি নিঃসঙ্গ।”
অনির্বাণের কাহিনি আসলে আধুনিক এক নিঃসঙ্গ ভারতীয় ক্রীড়াবিদের কাহিনি। ক্রিকেটের ঢক্কানিনাদ ও তারকা ভজনার অনেক দূরের এক স্টেশনে থেকে তাঁর সাধনা বিশ্বসেরা হওয়ার। যাঁর জীবনে টাইগার উডস যেমন আছেন, তেমনই রয়ে গিয়েছে মায়ের রান্না করা পটল পোস্ত। বন্ধুদের সঙ্গে সময় পেলেই উটিতে লং ড্রাইভ যেমন আছে, তেমনই রয়ে গিয়েছে ঈশ্বরকণা নিয়ে জানার আগ্রহ। অবসরেও এ ছেলের সিলেবাসে আইপিএল নেই, নেই সচিন তেণ্ডুলকরও! বরং তাঁর হিরো ক্যানসারজয়ী সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রং। এক কথায় ‘চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্য’কে টপকে এ ছেলের লক্ষ্য ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ প্রবেশের ছাড়পত্র।
বাঙালি ক্রিকেট খেলতে পারে না, সযত্নলালিত এই সর্বভারতীয় ধারণাটার মূলেই কুঠারাঘাত করার কলজেটা শতাব্দীর গোড়ায় দেখিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর ধারাবাহিক ভাবে বহন করেছেন তার দায়। বাঙালি গল্ফে বিশ্বসেরা হতে পারে বা কাছাকাছি পৌঁছতে পারে, এমন একটা স্বপ্ন লিথ্যামের গল্ফ কোর্সে তুলি দিয়ে এঁকেছেন অনির্বাণ। শুরু হয়েছে অসম্ভবকে সম্ভব করার এক ধারাবাহিক উপন্যাস। নিঃশব্দে উঁচু কোনও শৃঙ্গ মাথায় রেখে এগোচ্ছেন, কিন্তু ওই শৃঙ্গের দিকে ছোটার জন্য স্বাভাবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। ছোটাটাই যার কাছে শেষ কথা নয়, ‘গল্ফের দ্রাবিড়’ হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় কোথায়?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.