‘খেলোয়াড়ি’ জিন ডোপিংয়ের জুজু
লন্ডন অলিম্পিক-আকাশে

বাকি মাত্র তিন দিন। কিন্তু প্রস্তুতির ফাঁকে কোথায় যেন কালো মেঘ ঘনিয়েছে লন্ডন অলিম্পিকের আকাশে! ‘জিন ডোপিং’-এর আশঙ্কার মেঘ। যার সূত্র ধরে প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ছে অ্যাথলিটদের চোখ-ধাঁধানো সাফল্য।
জিন ডোপিং কী?
সাধারণত ক্রীড়াজগতে ‘ডোপিং’ বলতে বোঝায় উদ্দীপক কিছু ওষুধের সাহায্যে (স্টেরয়েড, অ্যান্ড্রোজেন ইত্যাদি) সাময়িক ভাবে খেলোয়াড়ের ‘পারফরম্যান্স’ বাড়ানোর প্রক্রিয়া। ক্ষমতাবর্ধক ওষুধগুলোর কোনও স্থায়ী প্রভাব দেহে থাকে না। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে জিনের চরিত্র বদলে ফেলে ক্ষমতাবৃদ্ধির খেলোয়াড়ি প্রয়াসই হল জিন ডোপিং। এ ক্ষেত্রে শরীরে (বিশেষত পেশিতে) কোনও বিশেষ জিন বা জিনের অংশবিশেষ ঢুকিয়ে কিংবা ওষুধের মাধ্যমে দেহের কোনও বিশেষ জিনকে উদ্দীপিত করে অ্যাথলিটদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা বাড়ানো হয়।
এবং শুনতে নতুন লাগলেও এটি ক্রীড়াজগতে ইতিমধ্যে বেশ ‘নাম’ করে ফেলেছে। বস্তুত ২০০৩ সালেই জিন ডোপিংকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (আইওসি)। ২০০৪-এ আন্তর্জাতিক ডোপিং-বিরোধী সংস্থা (ওয়াডা)-র ডোপিং তালিকায় ঢুকে পড়ে জিন ডোপিং। তবু গত ক’বছরে বিভিন্ন বিদেশি অ্যাথলিটের বিরুদ্ধে জিন ডোপিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৬-এ তুরিনের উইন্টার অলিম্পিক এবং ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকেও সন্দেহের নিশানা হয়েছেন বেশ কিছু অ্যাথলিট।
অবশ্য কারও বিরুদ্ধেই জিন-জালিয়াতির অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। কারণ, রক্ত বা মূত্র পরীক্ষায় মামুলি ডোপিং ধরা গেলেও জিন-ডোপিং ধরা অসম্ভব। আর জিন ডোপিং হাতে-নাতে ধরার মতো পরীক্ষিত কোনও পদ্ধতি এখনও অধরা। সমস্যাটা কী?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, জাতি-বয়স-লিঙ্গ-খাদ্যাভ্যাস বা দীর্ঘকালীন শারীরিক কসরতের ফলেও শরীরে প্রোটিনের জোর বাড়তে পারে, যার ফলে বদলে যেতে পারে জিনের চরিত্র। আবার জন্মসূত্রেও অনেকে ‘খেলোয়াড়ি’ জিনের বাহক হতে পারেন। যেমন হয়েছেন ফিনল্যান্ডের ইরো মান্তিরান্তা। সাত বার অলিম্পিক সোনাজয়ী এই স্কি-চ্যাম্পিয়ন জন্মগত ভাবেই পরিবর্তিত ‘ইপিও’ জিনের অধিকারী। তার দৌলতে ইরোর দেহে স্বাভাবিকের অন্তত ২৫%-৫০% বেশি লোহিত রক্তকণিকা রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তা ইরোর রক্তের অক্সিজেন ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। কৃত্রিম ভাবে জিন পাল্টানো ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে এঁদের ফারাক কী ভাবে করা যাবে, তা নিয়েই ফাঁপরে আইওসি এবং ওয়াডা। পুরো বিষয়টি এখনও গবেষণার স্তরে থাকায় কেউ জিন ডোপিং করলেও ধরার উপায় থাকছে না বলে অভিমত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ও বিজ্ঞানীমহলের একাংশের।

বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রেও ব্যাপারটার একটা আন্দাজ মিলছে। তাতে বলা হয়েছে, অলিম্পিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোনাজয়ী নানা অ্যাথলিটের জিন-মানচিত্র যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ পুরুষ স্প্রিন্টারের শরীরে ‘এসিটিএন-৩’ জিনের রূপভেদ (৫৭৭-আর অ্যালিল) রয়েছে, যা কি না খেলোয়াড়ি ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। গবেষকদলের অন্যতম হুয়ান এনরিকেজ ও স্টিভ গুলানস জানিয়েছেন, ক্রীড়ামহলে ‘পাওয়ার জিন’ নামে খ্যাত ওই ‘৫৭৭-আর অ্যালিল’ আফ্রিকার অন্তত ৮৫% মানুষের দেহে পাওয়া যায়, যাদের অনেকে খেলোয়াড় না-হলেও খেলোয়াড়োচিত শারীরিক সক্ষমতার অধিকারী। ওঁদের দাবি: এ পর্যন্ত এরিথ্রোপোয়েটিন (ইপিও), গ্রোথ ফ্যাক্টর, মায়োস্ট্যাটিন, এসিই, এন্ডোনেফ্রিন-সহ প্রায় দু’শো রকমের ‘খেলোয়াড়ি’ জিনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। চমকদার আর একটি তথ্য দিয়েছেন স্টিভ-হুয়ানরা। তাঁদের মতে, নেপালি শেরপাদের ৯৪ শতাংশের শরীরে ‘এসিই’ জিনের রূপভেদ আছে। তার সুবাদেই শেরপারা অক্লেশে আট হাজার মিটার উচ্চতায় তরতরিয়ে উঠে যেতে পারেন।
কিন্তু নিছক মেডেলের জন্য বাইরের জিন শরীরে ঢোকানো কি নিরাপদ? ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন থেরাপি সংক্রান্ত গবেষক তথা ওয়াডা-র চেয়ারম্যান থিওডোর ফ্রায়েডম্যানের বক্তব্য: না-জেনে, না-বুঝে অনেক অ্যাথলিট গোপনে জিন ডোপিং করছেন। এতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। ক্রীড়াক্ষমতা বাড়াতে যাঁর দেহে ‘খেলোয়াড়ি’ জিন প্রবেশ করানো হচ্ছে, তাঁর শরীর আদৌ সেই চাপ নিতে পারবে কি না, সেটা যাচাই করা হচ্ছে না। ফলে অনেকে ক্যানসার বা অন্য কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারও কারও মৃত্যুও হচ্ছে। “খেলোয়াড়েরা অবিলম্বে সচেতন না-হলে বিপর্যয় ডেকে আনবেন।” হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ফ্রায়েডম্যান। ফিফা-র মেডিক্যাল অ্যান্ড ডোপিং কন্ট্রোল অফিসার নিশীথরঞ্জন চৌধুরীর আক্ষেপ, “চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তির সুফল যে জিন থেরাপি, তা-ই কাজে লাগিয়ে কিছু লোক এই কাজ করছে। কুফলের কথা মাথায় রাখছে না।”
সাধারণ ডোপিংয়ের মাত্রা তো ধরা যায়। তেমন জিন ডোপিংয়েরও কোনও মাত্রা আছে কি?
এই বিষয়টিও গবেষণার স্তরে থাকায় নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে শারীরবিদ্যার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “দৈনিক ৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্যাফেইন শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলে না। মাত্রাটা তার বেশি হলেই মুশকিল। তাই দৈনিক ৫ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করলে ওয়াডা-র তালিকা অনুযায়ী তা ডোপিং। কিন্তু জিন-থেরাপির মাধ্যমে বাইরে থেকে জিন শরীরে ঢোকানোর পরে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর না-গেলে ক্ষতিকর প্রভাব যাচাই করা সম্ভব নয়।” কাজেই জিন ডোপিংয়ের মাত্রাও নির্ধারিত হয়নি।
জিন ডোপিং প্রমাণের উপায় কী হতে পারে? অমিতবাবুর মতে, দু’ভাবে এটা ধরা যেতে পারে। এক, সন্দেহভাজনের নিকট আত্মীয়দের ডিএনএ পরীক্ষা করে ওই অ্যাথলিটের ডিএনএ-র সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ কোনও পরিবর্তন নজরে এলে ধরে নিতে হবে, তাঁর জিনে কৃত্রিম অদলবদল হয়েছে। অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও খেলোয়াড়ের নাম নথিভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জিন-বিন্যাস দেখে নিতে হবে। কিন্তু দু’টোই যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। যে কারণে তার বাস্তব প্রয়োগ এখনও চিন্তাভাবনার স্তরেই রয়েছে বলে জানিয়েছেন অমিতবাবু। পাশাপাশি তিনি বলছেন, “জিন ডোপিং-ও যথেষ্ট ব্যয়বহুল পদ্ধতি। তাই ভারতীয় অ্যাথলিটদের মধ্যে এটির প্রয়োগ-সম্ভাবনা বিদেশের তুলনায় কম।”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.