বয়স তখন মেরেকেটে একুশে। বয়সের তুলনায় কিছুটা যেন রাশভারিই দেখাত তাঁকে। কিন্তু সে দিনের সদ্য যুবকটি যে এত ‘লম্বা দৌড়ের ঘোড়া’ তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।
১৯৫৭ সালে হাওড়ার আমতার তাজপুর এম এন রায় ইন্সটিটিউটে প্রণব মুখোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক হিসাবে। মূলত বাংলা-ইংরেজি-সহ কলাবিদ্যার ক্লাস নিতেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন ষাটোর্ধ্ব। কেউ কেউ সত্তর ছুঁইছুঁই। কিন্তু এত দিন পরেও প্রিয় মাস্টারমশাইকে নিয়ে তাঁদের নানা স্মৃতি এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রপতি পদে প্রণববাবুর শপথ গ্রহণ এখন সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই উৎসবের মেজাজ এই স্কুলে। |
শিক্ষক হিসাবে তাজপুর গ্রামে প্রথম যে দিন এলেন প্রণববাবু, সেই দিনটার কথা এখনও মনে আছে চিত্ত চক্রবর্তীর। স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন কর্মী চিত্তবাবু বললেন, “তখন শীতকাল। একটা বেডিং নিয়ে মাস্টারমশাই হাজির হলেন আমাদের স্কুলের সামনে। তৎকালীন সম্পাদক নবেন্দুভূষণ রায়ের বাড়ি দেখিয়ে কোথায় জানতে চাইলেন। রায়পাড়ায় আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল নবেন্দুবাবুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে দিলাম মাস্টারমশাইকে।”
নবেন্দুবাবুর বাড়ির একটি ঘরেই থাকার ব্যবস্থা হল প্রণববাবুর। টিনের ছাউনি দেওয়া একতলা ছোট ঘর। তাতে একটি তক্তোপোশ এবং বসার জন্য চেয়ার। নবেন্দুবাবু চিত্তবাবুর বাবা যদুপতি চক্রবর্তীকে অনুরোধ করলেন তাঁর বাড়িতে যেন প্রণববাবুকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়।
প্রণববাবুর জন্য রান্না করতেন চিত্তবাবুর মা রাধারানিদেবী। চিত্তবাবুর কথায়, “মাস্টারমশাই পছন্দ করতেন মায়ের হাতের রান্না করা মুলোসাঁই-এর চচ্চড়ি।” মধু খেতে পছন্দ করতেন প্রণববাবু। অজয় বড়াল নামে তাঁর আরও এক প্রাক্তন ছাত্র বললেন, “যে ঘরে তিনি থাকতেন তার চারপাশের গাছগাছালিতে মধুর চাক হত। একদিন তিনি আমাদের কয়েক জনকে জানলার পাশেই একটি মৌচাক দেখিয়ে সেটি ভেঙে আনতে বললেন। পরে পয়সা দিয়ে আমাদের বললেন, পাউরুটি কিনে আনতে। সকলে মিলে পাউরুটি দিয়ে মধু খাওয়া হল।” |
অজয়বাবু ছাড়াও তাঁর আরও এক প্রাক্তন ছাত্র নিমাই রায় বলেন, “রাতে আমাদের পালা করে মাস্টারমশাইয়ের ঘরে শুতে হত। মনে হয় তিনি একটু ভিতু ছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি একাই শুতেন।” বছর বিরাশির রণেন্দ্রনাথ কাঁড়ারের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল প্রণববাবুর। তিনি বললেন, “স্কুল ছুটির পরে প্রতিদিন বিকেলে আমরা দু’জনে ফতেপুরে দামোদরের ধারে বেড়াতে যেতাম। সপ্তাহে দু’দিন আমতায় ডাকবাংলোয় যেতাম রেডিও শুনতে।”
প্রণববাবু মাস ছ’য়েক শিক্ষকতা করেছিলেন এখানে। তার পরে ১৯৯৫ সালে তিনি ফের এই স্কুলে আসেন। তবে শিক্ষক হিসাবে নয়। স্কুলের শতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন প্রধান অতিথি। ওই সময়ে তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। স্কুল পরিচালন সমিতির তৎকালীন সম্পাদক অশোক কাঁড়ার বলেন, “মঞ্চে বসে উনি প্রাক্তন ছাত্রদের নাম ধরে ধরে খুঁজেছিলেন। গাড়ি যাওয়ার রাস্তা না-থাকায় পায়ে হেঁটেই রায়পাড়ায় চিত্তবাবুদের গিয়েছিলেন তিনি।” |
স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক সনৎ পাল বলেন, “যত দূর জানি প্রণববাবু বেতন পেতেন মাসে ১০৮ টাকা। যে স্কুল বাড়িতে তখন পঠন-পাঠন হত সেটি অবিকল রেখে দেওয়া হয়েছে। এই স্কুল থেকে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তা শেষ হল রাষ্ট্রপতিভবনে গিয়ে। ভাবতে অবাক লাগছে।” একই মন্তব্য প্রধান শিক্ষক পৃথ্বীষকুমার সামন্তেরও।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনিমা কাঁড়ার, ডোনা মালিক, প্রতিমা কাঁড়া অর্ক রায়দের বক্তব্য, “মাস্টারমশাই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আমরা চাই রাষ্ট্রপতি হিসাবে একবার অন্তত স্কুলে আসুন।”
|