ঐক্যের মধ্যেই অনৈক্য ইউপিএ শিবিরে |
অনমিত্র সেনগুপ্ত ও প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে ইউপিএ-র শরিক ও সহযোগী দলগুলির মধ্যে ঐক্যের ছবি ফুটে উঠলেও, নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিনেই আশঙ্কার কালো মেঘ দেখা দিল। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করলেও, খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে সমাজবাদী পার্টি যে সরকারের পাশে নেই, তা আজ চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন মুলায়ম সিংহ। এ বিষয়ে তিনি জোট বেঁধেছেন প্রকাশ কারাট ও অন্য বাম নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভোট মিটে যাওয়ার পরেই নতুন করে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়ার তোড়জোড় করছিল মনমোহন সরকার। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরাও বিদেশি লগ্নির সুফল নিয়ে সওয়াল করছিলেন।
অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরও রাজি করানোর চেষ্টা চলছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিরোধিতা করলেও এই ধরনের সংস্কারের কর্মসূচি রূপায়ণে মুলায়ম সিংহ যাদবের উপর ভরসা করছিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কিন্তু সেই ভরসায় জল ঢেলে দিয়েছেন মুলায়ম। তিনি এক দিকে বামেদের সঙ্গে একজোট হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এর বিরোধিতা করে চিঠি লিখছেন। আবার অন্য দিকে রাষ্ট্রপতি ভোট ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যে সাময়িক তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান ঘটানোয় উদ্যোগী হয়েছেন।
তৃণমূলও খুচরোয় বিদেশি লগ্নির প্রবল বিরোধিতা করছে। এ নিয়ে মমতার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন মুলায়ম। সম্মিলিত ভাবে এর বিরোধিতা করতে তিনি তৃণমূল নেতৃত্বকে বার্তা পাঠিয়েছেন। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কা, খুচরোয় বিদেশি লগ্নিকে কেন্দ্র করে ফের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলি জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আর গোটা প্রক্রিয়াতে অনুঘটকের কাজ করছেন সপা নেতা মুলায়ম সিংহ। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে একটি বৃহত্তর মঞ্চ গঠনে সক্রিয় রয়েছেন মুলায়ম।
ইউপিএ জোটের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও তৃণমূলের বিরোধকে উস্কে দিতেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিপিএম। শেষ বেলায় তৃণমূল প্রণবকে সমর্থন করলেও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল বলেই দাবি করেছেন প্রকাশ কারাট।
গত কাল মমতার রাজ্যে একলা চলো নীতির ঘোষণার দিকে ইঙ্গিত করে কারাটের যুক্তি, “দু’দলের মধ্যে সম্পর্ক সকলেই জানে। তৃণমূলের সমর্থনের পরেও কি সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে!” দলের কিছু অংশে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলেও কারাট দাবি করেছেন, “যে কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরেই দলের নিচুতলা থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও রাজ্য বা জেলা কমিটি আমাদের বলেনি যে প্রণববাবুকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।” এ বিষয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা প্রসেনজিৎ বসুর পদত্যাগের প্রশ্নে কারাটের বক্তব্য, ‘‘কারও ব্যক্তিগত মত ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু দলের মধ্যে সেটা বিরাট কোনও বিষয় নয়।” প্রণববাবুকে সমর্থন করলেও, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে সিপিএমও যে আগামী দিনে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে চলেছে, আজ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে মুলায়মের সঙ্গে সেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন কারাট। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে গত শীতকালীন অধিবেশনে শুধু বিরোধীরাই নয়, শরিক তৃণমূল, ডিএমকে, সমর্থক সপা, বসপা-র মতো দলগুলিও এর প্রতিবাদে সরব হয়। সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেও সুরাহা না হওয়ায় ওই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়।
এ বার সংস্কারের প্রশ্নে গতি আনতে ফের ওই বিষয়ে এগোতে গিয়েও বাধার মুখে পড়ল কেন্দ্র। আজ সপা, চার বাম দল ও এইচ ডি দেবগৌড়ার দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, এ দেশে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি এলে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জীবিকা হারাবেন। এমনিতেই চাকরির বাজার ছোট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সহমত না থাকায় এই প্রস্তাবকে ফের ঠান্ডাঘরে পাঠানোর দাবি জানিয়েছে দলগুলি। তৃণমূল সূত্রেও দাবি করা হয়েছে, ফের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি আনার চেষ্টা হলে তারাও আন্দোলনে নামবে। নবীন পট্টনায়কেরও এ বিষয়ে আপত্তি রয়েছে।
কংগ্রেস শিবিরের দাবি, খুচরোয় বিদেশি লগ্নি এলে ছোট ও মাঝারি শিল্পের উন্নতি হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। আর্থিক মন্দার কালো মেঘ অনেকটাই কেটে যাবে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে বাকি দলগুলির এই দূরত্ব কে মেটাবেন, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দলের অন্দরমহলে। এ যাবৎ ইউপিএ-র ‘সঙ্কটমোচন’ হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরে সেই ভূমিকায় কাকে দেখা যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে দলের মধ্যেই। এমনিতেই এনসিপির সঙ্গে কংগ্রেসের মন কষাকষি চলছে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস শিবির মনে করছে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে ফের এক বার শরিক ও বিরোধী দলগুলির পক্ষ থেকে কড়া বিরোধিতার মুখে পড়তে চলেছে ইউপিএ সরকার। |