সম্পূর্ণ হল বৃত্ত।
১৯৫২ থেকে ২০১২। ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য ১৯৫২ সালে যে লড়াই শুরু করেছিলেন কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়, এত দিনে তা আজ পূর্ণতা পেল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জয়ে।
দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে মোট ১৪ বার। এ পর্যন্ত তিন জন বাঙালি প্রার্থী মোট পাঁচ বার দেশের সর্ব্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করলেন কীর্ণহারের খর্বকায় বঙ্গসন্তানই। প্রণববাবুর আগে কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায় তিন বার এবং আরএসপি নেতা ত্রিদিব চৌধুরী একবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিলেও জয় ছিল অধরাই।
আজ প্রায় চার লক্ষ ভোটে জেতার পরে প্রণববাবুই প্রথম বাঙালি যিনি রাষ্ট্রপতি পদে আগামী ২৫ জুলাই শপথ নিতে চলেছেন।
স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহিত হওয়ার দিন থেকেই (১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ। প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৫২ সালে লোকসভা গঠিত হয়। সে বছরই সংবিধান মোতাবেক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। দেশাত্মবোধের হাওয়ায় সেই নির্বাচনে রাজেন্দ্রপ্রসাদের জয় কার্যত নিশ্চিতই ছিল। বিহারের এই রাজনীতিকের ‘ক্যারিশমায়’ মুগ্ধ তখন গোটা দেশ। তবু লড়াইয়ে নেমেছিলেন কৃষ্ণকুমার। তাঁকে নিয়ে মোট পাঁচ জন প্রার্থী ছিলেন সেই নির্বাচনে। মোট ছয় লক্ষ ভোটের মধ্যে রাজেন্দ্রপ্রসাদ একাই পান পাঁচ লক্ষের বেশি ভোট। ওই নির্বাচনে পঞ্চম হন কৃষ্ণকুমার। তিনি ভোট পান মাত্র ৫৩৩টি।
প্রথম বারের নির্বাচনে গো-হারা হেরে গেলেও কৃষ্ণকুমার হাল ছাড়েননি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও ফের ১৯৬৭ সালে চতুর্থ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি প্রার্থী দাঁড়ানোর ইতিহাস রয়েছে ওই নির্বাচনে। মোট ১৭ জন প্রার্থী ছিলেন সে বার। তাঁদের মধ্যে শেষ হাসি হাসেন জাকির হুসেন। প্রায় সাড়ে আট লক্ষ ভোটের মধ্যে পৌনে পাঁচ লক্ষ ভোট পেয়ে ভারতের চতুর্থ তথা প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপতি হন তিনি। কৃষ্ণকুমার পান সপ্তম স্থান। মাত্র ১২৫টি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে ৯ জন প্রার্থী খাতাই খুলতে পারেননি।
দু’বছরের মাথায় জাকির হুসেনের মৃত্যুতে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। পঞ্চম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে (১৯৬৯) মূল লড়াই ছিল ইন্দিরা গাঁধীর প্রার্থী ভি ভি গিরি ও বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস (সিন্ডিকেট) প্রার্থী নীলম সঞ্জীব রেড্ডির মধ্যে। সে বারও লড়াইয়ে নামেন কৃষ্ণকুমার। ১৫ জন প্রার্থীর লড়াইয়ে ভি ভি গিরি মাত্র এক লক্ষের কম ভোটে জেতেন। কৃষ্ণকুমারের প্রাপ্ত ভোট ছিল শূন্য।
ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়াই হয় ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ ও বঙ্গসন্তান ত্রিদিব চৌধুরীর মধ্যে। প্রথম থেকে সপ্তম লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর থেকে জিতে আসা ত্রিদিববাবু ছিলেন আরএসপি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠতা নেতা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া ছাড়াও তিনি গোয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। গোয়ায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে তাঁকে জেলে বন্দিও করে রেখেছিল তৎকালীন পর্তুগিজ শাসকরা। ১৯৭৪ সালের ওই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ত্রিদিববাবু ১ লক্ষ ৯০ হাজারের কাছাকাছি ভোট পান। আর প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ ভোটের মধ্যে সাড়ে ৭ লক্ষের বেশি ভোট পেয়ে ওই নির্বাচনে অনায়াসে জিতে যান ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ।
এর পর সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ নির্বাচন পর্যন্ত কোনও বঙ্গসন্তানকে দেখা যায়নি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ময়দানে। যদিও গত নির্বাচনে কোনও কোনও মহল থেকে প্রণববাবুর নাম প্রার্থী হিসাবে ভাবা হয়েছিল। প্রায় শেষ মুহূর্তে প্রতিভা পাটিলের নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। এ বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিস্তর রাজনৈতিক চাপানউতোরের পরে শেষ পর্যন্ত প্রণববাবুকেই ইউপিএ-র প্রার্থী ঘোষণা করেন সনিয়া। রাজনৈতিক সূত্র বলছে, প্রণব ম্যাজিকের কারণেই গোটা দেশে রাজ্য রাজনীতিতে যারা পরস্পরের কট্টর শত্রু সেই দলগুলিও ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থন করেছে। যার জেরে এনডিএ প্রার্থী পূর্ণ অ্যাজিটক সাংমাকে বিপুল ভোটে হারিয়ে সাফল্যের স্বাদ পেলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ই।
রাইসিনা হিল-এ প্রথম বাঙালির পা রাখা এখন সময়ের অপেক্ষা। |