দু’জনে দেখা হল। রুশ দেশের স্বর্ণকেশী ত্রিনাকে দেখেই ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরলেন উগান্ডার কৃষ্ণকলি সানিয়ু। দু’জনের কেউ কারও কথা এক বর্ণ বোঝেন না। তবু একসঙ্গে চকোলেট ভাগ করে খেতে খেতে তাদের উচ্ছ্বাস থামতেই চায় না। ভাষা-বর্ণ-ভূগোলের সীমারেখা তখন অবান্তর।
বুদাপেস্টের আলিয়া সহাস্যে বললেন, “ত্রিনা আর সানিয়ুর ভাব দেখলে ওদের মায়ের পেটের বোন বলেই মনে হবে।” রবিবার বিকেলে এই দুর্লভ আন্তর্জাতিকতার স্বাদ পেল কলকাতা। সৌজন্যে দেশ-বিদেশের যৌনকর্মী-সম্মেলন। স্বভূমিতে ৪২টি দেশের প্রতিনিধিদের আসর মানে নিছকই রোজকার বিবর্ণ বেঁচে থাকা নিয়ে হা-হুতাশ নয়। একসঙ্গে হাসি-গল্প, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়ার ‘অক্সিজেনে’ও প্রাণপণে বেঁচে নেওয়ার তাগিদটা ফুটে উঠল। যেমন, পেরুর লিমার তরুণী অ্যাঞ্জেলা এবং ক্যারিবিয়ন দ্বীপ গায়ানার রূপান্তরকামী পুরুষ ক্রেসি টিপের পাতা বাছলেন একসঙ্গে। অ্যাঞ্জেলার পিঠের উল্কিতে স্প্যানিশে কন্ডোম-সচেতনতার প্রচার। আলোকচিত্রীদের আর্জিতে পিঠ ফিরিয়ে মন দিয়ে ‘পোজ’ দিলেন তিনি। ক্রেসি-অ্যাঞ্জেলার গলাগলির ছবি তুলতেও ক্যামেরাধারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
জিম্বাবোয়ের পুরুষ যৌনকর্মী প্রাইটন কাটার কালো টি-শার্টে লেখা, ‘হোমোফোবিয়া, ট্রান্সফোবিয়া হার্টস।’ সমকাম ও রূপান্তরকামিতার প্রতি বিদ্বেষের প্রতিবাদ এ ভাবেই করতে চেয়েছেন তিনি। নিজের দেশে সমকামী তথা পুরুষ যৌনকর্মীদের সমস্যার কথা ইংরেজিতে বোঝাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন ক্যামেরুনের অ্যাডোনিস। ফরাসি থেকে ইংরেজিতে তর্জমার জন্য কানাডার কিউবেকের তরুণী জেন তাঁর মুশকিল-আসান হলেন। |
মানুষে মানুষে লিঙ্গ-জাতি-ভাষা-ধর্মের গণ্ডী মুছে সেতু বাঁধার এই চেষ্টাকেই ‘মনের স্বাধীনতা’ বলতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। যৌনকর্মীদের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক প্রকল্প, কলকাতার দুর্বার প্রমুখ বেশ কয়েকটি সংস্থার জোটে এই সম্মেলনের নামও তাই যৌনকর্মীদের ‘স্বাধীনতার উৎসব’। কলকাতার রূপান্তরকামী পুরুষ ‘মধু’ বলছিলেন, “যৌনকর্মী থেকে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের এক মঞ্চে আসার এমন ‘স্পেস’ বড় একটা মেলে না।”
দুনিয়া জুড়ে নিপীড়নের যন্ত্রণাও সবাইকে এক বন্ধনীতে এনে ফেলেছে। তৃতীয় বিশ্বে নারী পাচার থেকে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে আশঙ্কায় সকলেই এক সুর। মহারাষ্ট্রের সামলির যৌনকর্মীরা তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের ‘অবমাননা’র ছবি তুলে ধরতে নাট্যাভিনয়কে হাতিয়ার করেছিলেন। তুরস্কের পুরুষ যৌনকর্মী কেমল অর্ডেক আঙ্কারা শহরে যৌনকর্মীদের উপরে পুলিশি জুলুমের ছবিটা তুলে ধরলেন। কেমলের মতে, পুলিশের ভয়ে যৌনকর্মীদের মধ্যে এড্স-সচেতনতার প্রচারও মার খাচ্ছে। সিডনির রেবেকা বলছিলেন, অস্ট্রেলিয়ায় কোথাও কোথাও আদিমতম পেশাটির আইনি স্বীকৃতি থাকলেও যৌনকর্মীদের ‘অপরাধী’ তকমায় দেগে দেওয়ার প্রবণতা দূর হয়নি। লোকলজ্জায় পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দস্তুর উন্নত দেশগুলোতেও কম নয়। কলকাতায় সমকামী-রূপান্তরকামীদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ দুঃখ করছিলেন, ফেসবুকে তাঁদের লক্ষ্য করে অশালীন আক্রমণও নিয়মিত সইতে হচ্ছে।
পরস্পরের দুঃখ ভাগ করার ফাঁকেই পুশকিনের কবিতা আওড়েছেন সেন্ট পিটার্সবার্গের নাতাশা। কলকাতার বিরিয়ানির মহিমায় ‘ক্লিন বোল্ড’ সকলে। দেশে ছেলেমেয়ের জন্য মনখারাপ দেখে কুয়ালালামপুরের তামিল বংশোদ্ভূত সেলভিকে সান্ত্বনা দিয়েছেন ঢাকার হাসিনা।
লিঙ্গগত পরিচয়ের বিতর্কে এ শহরেই এক নামী ক্রীড়াবিদের ‘হেনস্থা’র প্রসঙ্গও উঠেছে সম্মেলনে। বলিউড অভিনেত্রী ও রিয়্যালিটি শো-খ্যাত রূপান্তরকামী পুরুষ লক্ষ্মীনারায়ণ ত্রিপাঠীর কথায়, “সম্ভ্রমের সঙ্গে সকলের বাঁচার অধিকারটুকুই হল শেষ কথা।” শুক্রবার পর্যন্ত মিলনমেলায় হাতে হাত রেখে এই মর্যাদাই খুঁজবে ‘স্বাধীনতার উৎসব’। |