টিনের চালের ক্লাসরুম। দরজা-জানলার বালাই নেই। স্কুল ছুটির পরে তা আবার হয়ে যেত গরু-ছাগলের রাতের আস্তানা। পর দিন সকালে সেই নোংরা ঘরে ঢোকে কার সাধ্যি!
ছাত্রদের তাই রোজকার কাজ ছিল, স্কুল বসার আগে সাফ কর ক্লাসঘর। আর যে কিশোরটি অত্যন্ত নিষ্ঠা নিয়ে কাজটা নিয়মিত করে যেত, সে-ই আজ দেশের রাষ্ট্রপতি। প্রথম নাগরিক! সেই ‘পল্টু’র কথা বলতে গিয়ে রবিবার বারে বারে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছিলেন সহপাঠী মিহির চট্টোপাধ্যায়। বলছিলেন, “ও আর আমি একটা চুবড়িগাছের ডাল দিয়ে মেঝে সাফ করতাম। তার পরে ক্লাসে বসতাম।”
পল্টু অর্থাৎ প্রণব মুখোপাধ্যায়।
সে পঞ্চাশের দশকের কথা। বীরভূমের কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুলের ক্লাসরুম বলতে তখন গোটা কয়েক টিন আর খড়ের চালের ঘর। তাতেই চলত ক্লাস ফাইভ থেকে টেন-এর পঠন-পাঠন। সেখানে প্রণববাবুর সঙ্গে পড়তেন বলদেব রায়ও। বললেন, “পল্টু হঠাৎ নিয়ম করল, নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। ইংরেজি ভুল বললেও ক্ষতি নেই, কিন্তু মাঝে বাংলা বলা চলবে না। বললেই বাংলা শব্দপিছু এক আনি জরিমানা!” ফল? “অনেকে জরিমানা দিত। পল্টুকে কখনও দিতে হয়নি।”
মিহিরবাবু ও বলদেববাবু দু’জনেই পরে কীর্ণাহার শিবচন্দ্রের শিক্ষক হন। দু’জনেই এখন অবসর নিয়েছেন। এ দিন দক্ষিণ শহরতলির ডায়মন্ড পার্কের বাড়িতে বসে সহপাঠীর শীর্ষপদে আরোহণের খবর দিনভর টেলিভিশনে দেখেছেন মিহিরবাবু। আর ডুব দিয়েছেন অতীতে। বললেন, “আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হত আয়ুব হোসেন। সেকেন্ড আর থার্ড কে হবে, তা নিয়ে আমার আর প্রণবের টক্কর চলত।” তবে একটা ব্যাপারে সকলকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন প্রণব। সেটা বই পড়া (যে অভ্যাস আজও তাঁর সঙ্গী)। মিহিরবাবু বললেন, “আমি ছিলাম ফুটবল অন্ত প্রাণ। পল্টু ফুটবল ভালবাসলেও খেলতে চাইত না। আমি জবরদস্তি ওকে মাঠে নিয়ে যেতাম। ও সঙ্গে করে বই নিয়ে যেত। সাইড লাইনে বসে পড়তে পড়তে খেলা দেখত।” মিহিরবাবুর কথায়, “ক্লাস টেনে যখন উঠলাম, তখনই প্রণব একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি!” |
তবে রাইসিনার নতুন বাসিন্দা ফুটবলটা একেবারেই খেলেননি, এমন কিন্তু নয়। বলদেববাবু বলছিলেন, “পল্টু মূলত ডিফেন্সে খেলত। তবে
ওর পা এড়িয়ে বল গোলে ঢুকে গেলে খুব রাগতে দেখিনি। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে কাউকে জমি ছাড়েনি। ফুটবলে যে ডিফেন্স করত, সেটা তার
দল আর দেশের জন্যও এত দিন করে গিয়েছে। ডিফেন্স করতে করতেই ও আজ দেশের সর্বোচ্চ পদে পৌঁছেছে। আশা রাখি, এ ক্ষেত্রেও ভাল ডিফেন্স করবে।”
নেতা হওয়ার সহজাত ক্ষমতা ছিল প্রণবের। তাঁর কিশোর বয়সের সঙ্গীরা সে কথাই বলছেন। মিহিরবাবু একটা দৃষ্টান্তও দিলেন, “বোধহয় সেভেন-এইটে পড়ি। এক দিন গিয়ে দেখি ক্লাসরুম ছত্রভঙ্গ, মাস্টারমশাইয়ের টেবিল-চেয়ারও ভাঙা! হেডস্যার রামশম্ভুবাবু তো রেগে আগুন! বললেন, তোমরাই ভেঙেছ। জরিমানা দিতে হবে। আমরা ভয়ে অস্থির। শেষে বাঁচাল প্রণব।”
কী ভাবে? মিহিরবাবু জানাচ্ছেন, “ও-ই তখন রুখে দাঁড়াল। বলল, আমরা যা করিনি, তার জন্য শাস্তি কেন পাব? ওরই নেতৃত্বে আমরা ক্লাস বয়কটের ডাক দিলাম।” তবে শেষ পর্যন্ত সব শান্তিতেই মিটেছিল। “প্রণবের প্রত্যয় দেখে হেডস্যারও ওর খুব প্রশংসা করেছিলেন।”
সহপাঠীদের ঝুলি যেন এ দিন ফুরোতেই চায় না! মিহিরবাবু বলছিলেন, “স্কুলে একটা মাত্র টিউবওয়েল ছিল। তা-ও হামেশা বিগড়ে যেত। আবার কুয়োর জল খাওয়া যেত না, এত নোংরা।” তখন দল বেঁধে জমিদারবাড়িতে জল খেতে যেতেন তাঁরা। সঙ্গে থাকতেন প্রণবও। “কখনও পেয়াদা তাড়া করত। তখন সবাই দে ছুট!”
শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরে বলদেববাবু এখন কীর্ণাহারেরই বাসিন্দা। বলছিলেন, “কোনও স্যারের ক্লাস ভাল না-লাগলে পল্টু পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই গুঁজে পড়ত। দেখাদেখি আমরাও। কখনও-কখনও ধরা পড়েছি। বকুনি তো বটেই, মারও জুটেছে।”
আরও একটা ব্যাপারে বন্ধুদের জুটিয়ে হইচই করতে ভালবাসতেন প্রণব। দুর্গাপুজো। যে টানে যাবতীয় কাজের চাপ সরিয়ে গত বছর পর্যন্ত গিয়ে হাজির হয়েছেন মিরাটিতে নিজের বাড়িতে। বলদেববাবুও বলছিলেন মুখুজ্জেবাড়ির সেই পুজোর কথা। বলছিলেন, “ওটা তো ছিল ক্লাসের সকলের পুজো! ষষ্ঠীর দিনই পৌঁছে যেতাম পল্টুদের মিরাটির বাড়িতে। ফিরতাম দশমী কাটিয়ে।” পুজোর চার দিন ওখানে কী হতো, তা-ও ওঁর স্মৃতিতে টাটকা। “কবিগান হতো। গানের বহু লাইন পল্টু মুখস্থ বলত ঝরঝরিয়ে।”
বাল্য-কৈশোরের এ হেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশের সাংবিধানিক শীর্ষ পদে বসতে চলায় ওঁরা যারপরনাই আপ্লুত। বলদেববাবু বলেন, “আমার সহপাঠীটি যে এক দিন কেউকেটা হবে, তা জাতীয় রাজনীতিতে ওর উত্থান দেখেই বুঝেছিলাম। ভাবতেই পারছি না, ওরই পাশে বসে দিনের পর দিন কাটিয়েছি!” আর মিহিরবাবুর সহাস্য মন্তব্য, “বড় বিপদে পড়ে গেলাম! পল্টুকে কি এখন ইয়োর এক্সেলেন্সি বলে সম্বোধন করতে হবে!” |