|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
ডানা ভাঙা পরি |
তিলোত্তমা মজুমদার |
রাখী এখন খুব আনন্দে আছে। আর মাত্র পাঁচ দিন। তার পরেই মঙ্গলবার তারা কলকাতায় যাবে কালীঘাটে পুজো দিতে। তার পর ঘুরবে বেড়াবে। ভাবলে বুকের ভেতর শিরশির করছে। দুর্গাপুজোয় নতুন জামা পরার সময় অনেকটা এই রকম লাগে। তবে এ বারের আনন্দ অনেক বেশি। এই প্রথম রাখী কলকাতায় যাচ্ছে। দারুণ ব্যাপার।
রাখী থাকে অর্জুনপুর গাঁয়ে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জয়নগর-মজিলপুর ছাড়িয়ে একেবারে সেই প্রান্তে। মজিলপুরে নেমে প্রথমে অটোয় চেপে পল্টনি, তার পর পল্টনি থেকে ভ্যান রিকশায় অর্জুনপুর। শুনতে একটুখানি। কিন্তু অর্জুনপুর থেকে মজিলপুর যাওয়াই কিছু চাট্টিখানি কথা নয়। তার পর কলকাতা সে কত দূর!
রাখীর বয়স ঠিক বারো। তবে দেখায় আরও কম। বয়সের হিসেবে বাল্য ছাপিয়ে কৈশোর আসি-আসি করছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে এখনও বিস্ময়ের অপার শৈশব। তার প্রতিফলন চোখেমুখে। কথায় বলে, মুখ মনের আয়না। তারও মুখের ত্বকে শৈশবোচিত কোমলতা। শরীরটি রোগা পাতলা শ্যামলা-শ্যামলা। খাঁদা নাক। শান্ত, কালো চোখ। ক্লাস সিক্সে পড়ছে। ফোর পর্যন্ত পড়ত অর্জুনপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখন বড়দার ভ্যানে চেপে পল্টনি হাইস্কুলে যায়। অনেকেই হেঁটে যায় এতটা পথ। কিন্তু রাখীর বড়দাদাটি তাকে কষ্ট করতে দেয় না।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড়দা কমল জ্যেষ্ঠ। তার পর দিদি পাখি। পাখির বিয়ে হয়ে গেছে স্কুলে পড়তেই। খুব দূর কিছু নয়। বহেড়ু। জামাইবাবু অলকের মিষ্টির দোকান আছে। তা ছাড়া একটা খেজুরের বাগান। প্রত্যেক শীতে মোয়ার কারখানা খোলে অলক। রাখীর মেজদা অমলকে নিয়ে কলকাতার গড়িয়াতে দোকান দেয়। টানা চার মাস। রাখীর খুব ইচ্ছা এক বার যায়। দোকানে বসে।
সব দিক থেকে দেখতে গেলে রাখীর দিদি পাখির বেশ ভাল বিয়ে হয়েছে। দুই মেয়ে। ছোটটার দুই, বড়টার চার। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পাখি এখন ব্যস্ত গিন্নি। সে যখন বাপের বাড়িতে আসে, রাখীর খুব মজা। বাচ্চা দুটো একেবারে জ্যান্ত পুতুল। তার লেখাপড়া মাথায় ওঠে তখন। তার জন্য যে কেউ বকবে, এমন নয়। মেয়েদের পড়া হল কি না, তা নিয়ে এ বাড়ির কেউ আগ্রহী নয়। নিজের গরজে পড়লে পড়ল। এই যে পাখি, দু’চার বার ফেল-টেল কি করেনি? করেছে। তাও দেখো, নবম শ্রেণিতে উঠতেই কী চমৎকার বিয়ের যোগাযোগ হয়ে গেল! সে তো আর ওই নবম শ্রেণি বলে নয়। হ্যাঁ, মেয়ে একটু আধটু লেখাপড়া জানে, এতে বিয়ের বাজারে ভালই দর জোটে। কিন্তু তার সঙ্গে বেশ একটা ঢলো ঢলো চেহারা, নম্র ব্যবহার চাই। আর এই সব কিছুর সঙ্গে চাই গৃহকর্ম নৈপুণ্য। বউ ভাত-ডাল-মাছের ঝোল রেঁধে পাতে দেবে, বাসন মাজবে, কাপড় কাচবে, উঠোন ঝাঁট দেবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করবে, বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ করবে, তবে না! এর মধ্যে উচ্চশিক্ষা কী কাজে লাগে!
|
|
তবে কিনা, রাখী লেখাপড়া ভালবাসে। কলকাতার নামী কলেজে পড়ার ইচ্ছা তার। অলক মজা করে বলে, ‘ছোট গিন্নি, মেয়েদের লক্ষ্মী-লক্ষ্মী ভাবটাই ভাল। সরস্বতীর ভাব লাগলে বিপদ বুঝলে!’
রাখী বোঝে না। তার সরল চোখ বিস্মিত নীরব দৃষ্টির মধ্যে জিজ্ঞাসা ভরে দেয়। অলকের কথার ব্যাখ্যা কেউ করে দেয়নি। রাখী নিজের বুদ্ধিতে তার অর্থ করার চেষ্টা করে। এইটুকু বোধ হয়, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা অলকের পছন্দ নয়। কেন? এর উত্তর রাখীর পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তাই নিয়ে সে চিন্তিতও নয়, উদ্বিগ্নও নয়। পড়া নিয়ে কেউ তাকে বকছে না, এই বেশ। মায়ের হাতে হাতে ঘর-গেরস্থালির কাজ করে দেওয়ার আগ্রহ নেই বলেই যা কিছু বকুনি খায় সে। পাখির সঙ্গে তুলনা চলে হরদম। রাখী-পাখির মা, গৌরী বলে, ‘তোর বয়সে পাখি হেন কাজ নেই যে পারত না। তোকে তো কোলে-কাঁখে ও-ই করেছে। ওর বিয়ে হয়ে অব্দি আমার দম ফেলার সময় নেই। কবে যে কমলের বিয়ে দেব! ঘরে বউ এলে বেশ দু’জনে মিলে সংসার সামলানো যেত।’
কমলকে বিয়ের কথা বললেই রাগ করে। বলে, ‘এখনই কী!’
গৌরী বলে, ‘আশ্বিনে তেইশে পড়বি। কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে জানিস?’ ‘ভাল সম্বন্ধ? আমার? কী যে বলো মা তুমি!’ ‘কেন? না আসার কী? তুই কি আমার খারাপ ছেলে? শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে আমার। বিয়ের জন্য আর কী লাগে!’ ‘অনেক কিছু লাগে মা। শহরের শিক্ষিত ছেলেরা তেইশে বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারে না। আগে আখের গুছোয়, তার পর।’ ‘তুই আর কী গুছোবি? বাপের জমি আছে। নিজের বাড়ি। আর একটা মাত্র বোন, বিয়ে হলেই নিশ্চিন্তি। তো তার এখনও ছ’সাত বছর দেরি। তুই নিশ্চয়ই এত দিন বসে থাকবি না? নিজে রোজগার করছিস। আর ভাবনা কী?’ ‘পাখির বিয়ের সময় যে জমিটা বাঁধা দিয়েছিল বাবা, সামনের বছর তার টাকা শোধ হয়ে যাবে। পণের টাকা তো কম নেয়নি অলক। ওই জমি আবার বাঁধা দেব মা বুঝলে। একটা অটো কিনব আর কিছু টাকা জোগাড় করে। মজিলপুর-পল্টনি রুটে এখনও অটোর চাহিদা আছে। শুনছি কী সড়ক যোজনা প্রকল্প করছে সরকার। এই অর্জুনপুরের রাস্তাও এ বার ভাল হয়ে যাবে। পাকা রাস্তা মা, পাকা রাস্তা। আমি তখন মজিলপুর টু অর্জুনপুর রুট করব। দারুণ হবে।’ ‘আহা! তোকেও পণ দেওয়ার জন্য কত মেয়ের বাপ মুখিয়ে আছে।’ ‘পণ নেওয়ার উপযুক্ত হতে হয় মা। অলককে যা দিয়েছি, তার দ্বিগুণ উশুল করব। তবে তার জন্য তৈরি হতে হবে। ভ্যান চালালে দশ হাজার, অটো চালালে এক লাখ। কোনটা ভাল?’
অমলের ইচ্ছা পাকাপাকি ভাবে মোয়ার ব্যবসায় নেমে যায়। অলকের কারখানায় খুব মন দিয়ে কাজ শিখছে সে। কমল বলেছিল, ‘জয়নগর-বহেড়ুর মোয়া দিয়ে তো চার-পাঁচ মাস ব্যবসা হবে, তার পর?’
অমল বলে, ‘জামাইবাবুর সঙ্গে গিয়ে কি এমনি এমনি পড়ে থাকি? ও ভাবে, ফোকটে ছোট শালাকে বেশ খাটিয়ে নিচ্ছে। আমি এই সুযোগে অনেক কিছু ছকে ফেলেছি। যে সময়টায় ব্যবসা থাকবে না, সেই বাকি সময়টায় নিজেদের জমিজমা দেখব। নিজেরা না দেখলে কিছু থাকবে নাকি? বাবার বয়স হচ্ছে না? তুই তো রাতদিন তোর গাড়ি নিয়ে পড়ে থাকবি। পাড়ার দু’চারটে মেয়ে-বউ জোটাতে হবে বুঝলি।’ ‘কী করবি?’ ‘আচার, বড়ি, মোরব্বা, তিলের নাড়ু, মোয়া সব বানাবে। মুড়ি-চিঁড়ের মোয়া। সপ্তাহে এক দিন করে কলকাতা চলে যাব। বেশি না, দশটা ফ্ল্যাটবাড়ি ধরতে পারলেও অনেক।’
দৈনন্দিন না হলেও এমন আলোচনা মাঝেমধ্যেই হয়। রাখীর বাবা জিতু মণ্ডল চুপচাপ মানুষ। চাষ-বাস তার ধ্যান-জ্ঞান। বীজ, সার, প্রকৃতি, আবহাওয়া নিয়ে কথা বললে তার আগ্রহ জাগে, নইলে অন্য কথা সে শুনছে কী শুনছে না, বোঝা পর্যন্ত যায় না। গৌরী ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প করে, ‘তোদের বাবার কথা আর বলিস না। নতুন বিয়ে হয়ে এসেছি। রাত্তির বেলা। বাড়িতে লোকজন। উঠোনের হ্যাজাক বাতিটাও নিভে গেল। যে-যার মতো শোবার তোড়জোড় করছে। তোদের বাবা দেখি হাতে লণ্ঠন নিয়ে বেরুবার উদ্যোগ করছে। বলি, অত রাতে কোথা যাও? বলে, ‘বীজতলা।’ আমি তো ভয়ে মরি। শাশুড়ি বলে, ‘ভয় পেয়ো না। ও ওমনিই। ধান পাকলে আরও দেখবে। তখন মাঝরাত্তিরে গিয়ে ধানের মাথায় হাত বুলোয়। কত বলি, রাত-বিরেতে যাসনে। সাপে কাটবে। কথা শুনলে তো।”
জিতু মণ্ডলের ধারা পেয়েছে রাখীর ছোটদা সুবিমল। সাত বার প্রশ্ন করলে এক বার জবাব দেয়। কমল সিক্স পর্যন্ত পড়েছে, অমল টেনেটুনে সপ্তম শ্রেণি। একমাত্র সুবিমল এক বারও ফেল না করে দশম শ্রেণিতে পৌঁছেছে। সামনের বার মাধ্যমিক। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে আছে। ছুটির দিন বই-খাতা নিয়ে জমিতে চলে যায়। সেখানে একটু জিরোনের জন্য খড়ের দোচালা। তিন দিকে বাঁশের নিচু বেড়া দিয়ে, ইট বিছিয়ে ছোট্ট ঘেরাটোপ। সুবিমল সেইখানে বসে পড়ে। তার সঙ্গে রাখীও যায়। ছোট্ট পরির মতো লাফাতে লাফাতে। সুবিমল রাগ করে না। রাখীর যতক্ষণ ইচ্ছে পড়ে, তার পর খেলে বেড়ায়। বুলবুলি, ফিঙে, শালিক তাড়া করে। বরবটি কী বেগুন খেতে উঁকি দেয়। বাবার পাশে পাশে মন দিয়ে দেখে চাষের কাজ। অথবা, অকারণের খুশিতে দু’টি হাত দু’দিকে ছড়িয়ে তালে তালে পা ফেলে নৃত্যপরতায় ছুটে যায়। তখন যেন সত্যিই সে এক স্বচ্ছ ডানার ছোট্ট পরি। শিগ্গির উড়বে বলে মহড়া দিচ্ছে! গম্ভীর, অন্তর্মুখী সুবিমল পর্যন্ত মুগ্ধ চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে।
|
|
ঘরোয়া আড্ডায় সুবিমল কখনও বলে না সে কী হতে চায়। বাড়ির আর কেউ জানে না সে কী ভাবছে, আর কেউ জানে না সে পড়ার বইয়ের বাইরেও অনেক কিছু পড়ে। শুধু রাখী জানে। সুবিমলকে ওই সব বই দেন পদার্থবিজ্ঞানের স্যর সন্দীপবাবু। রাখীকে বলেন, ‘মন দিয়ে পড়। দাদার মতো মাথা হওয়া চাই।’
দাদার মতো? দাদা কিন্তু ফার্স্ট-সেকেন্ড হয় না। আর স্কুলে প্রথম তিন জনের পর আর কে কত নম্বরে থাকল তার হিসেব কে নেয়!
রাখী বলেছে, ‘ছোটদা, তোর মাথা খুব পরিষ্কার, না?’
সুবিমল বলে, ‘কে বলল?’ ‘সন্দীপবাবু স্যর বলেন তো। তা ছাড়া তুই আমার সব অঙ্ক পারিস।’ ‘তুই সিক্স, আমি টেন।’ ‘তাতে কী! মিতালির দাদা এগারো ক্লাসে পড়ে। আমাদের অনেক অঙ্ক পারে না, হি হি!’ ‘হুঁ। সে যাক গে। মাথা পরিষ্কারের ভাল বাংলা কী?’ ‘কী রে?’ ‘মেধাবী।’ ‘ছোটদা, তুই তো মেধাবী, তা হলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হোস না কেন?’
সুদূর প্রসারিত ধানখেতের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করেছিল সুবিমল। তার পর বলে, ‘হতে চাই না।’ ‘কেন?’ ‘আমার বাবা কি পঞ্চায়েত সদস্য?’ ‘না।’ ‘জেলা পরিষদ?’ ‘না।’ ‘আমাদের বাবা কি জোতদার?’ ‘জোত মানে তো জমি, বাবার জমিও আছে, তা হলে বাবা জোতদার।’ ‘না। ছোট চাষি। ক্ষুদ্র নয়, ছোট। যে পরিমাণ জমি থাকলে জোতদার হওয়া যায়, তার এক-চতুর্থাংশও বাবার নেই।’ ‘তা হলে?’ ‘বাবা কি খুব ধনী? খুব কেউকেটা গোছের?’ ‘না।’ ‘শহর থেকে কোনও নেতা এলে কি আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেয়?’ ‘না।’ ‘আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় অভিনব দাসরায় মজিলপুরের বিধায়কের ছেলে। কী বুঝলি?’ ‘কিছু না।’ ‘পরে বুঝবি। শুধু শুনে রাখ, স্কুলের ফার্স্ট-সেকেন্ড কিছু নয়। আসল কথা, শেষ পর্যন্ত তুই কী হয়ে উঠলি।’ ‘তুই কী হবি রে ছোটদা?’ ‘বিজ্ঞানী।’
বিজ্ঞানী হতে পারা কত বড় সাফল্য রাখীর সম্যক জ্ঞান নেই। কিন্তু এটুকু সে বোঝে, বিজ্ঞানী হওয়া খুব কঠিন। কারণ, তাঁরা আবিষ্কার করেন। পাঠ্য পুস্তকে বিজ্ঞানীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সে পড়েছে। সে বলে, ‘আমি বিজ্ঞানী হব না।’ ‘কী হবি?’ সুবিমল বলে। ‘আমি... আমি... বিজ্ঞানী না... আমি ডাক্তার হব। কলকাতায় পড়ব রে ছোটদা।’ ‘খুব ভাল। আমি পড়াব তোকে।’ ‘তুই? সে তো এখনই পড়াস।’ ‘সে পড়ানো নয়। সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বসিস না, তা হলেই হল।’
বিয়ে! ধুস! রাখীর ও-সব ভাবতে ভালই লাগে না। ভবিষ্যতে কী হবে, এই নিয়েই সে কল্পনার জগতে থাকে। আগে শুধু কলকাতার নামী কলেজে পড়বে এইটুকু ভাবত। পল্টনির সিনেমা হলে যে ক’টা সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছে তার, তাতে কোনও এক সিনেমায় এক জন মেয়ে ডাক্তারকে তার খুব ভাল লেগেছিল। তাই থেকেই সে ডাক্তার হতে চায়। সিনেমাতেও বেশির ভাগ মেয়েই অবশ্য দিদির মতো। শুধুই ঘর-সংসার করে। তার বন্ধু মিতালি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। তার এক মাসতুতো দাদা নাকি পড়ছে। রাখী এখনও কম্পিউটার স্পর্শও করেনি। তবে দেখেছে। মিতালি মাসির বাড়ি গেলে তার মাসতুতো দাদা তাকে কম্পিউটার ধরতে দেয়। মেজদা কলকাতা থেকে একটা খেলনা টিভি আর একটা কম্পিউটার এনে দিয়েছে রাখীকে। রাখী খুব যত্ন করে তাদের। বাড়িতে টিভি নেই তো। বিদ্যুৎ-ই নেই। তিন বছর আগে অর্জুনপুরে প্রথম বিদ্যুৎ এল। খুঁটি আর তারের দাম দিতে হচ্ছে নাকি। জিতু মণ্ডল বলছিল। কমল বলে, ‘দরকার নেই বাবা। এত বছর চলে গেল, আর ক’টা বছর দাঁড়াও। এমনিই লাইন এসে যাবে।’ তারা সেই অপেক্ষায় আছে। সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য রাস্তা, সবার জন্য বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ এলে কী ভালই না হবে! ভাবে রাখী। পাখির বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। ফ্রিজ, টিভি। রাখী গেলে পাখি ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা শরবত খেতে দেয়। ওখানে রাখী ভূতের ভয়ও পায় না। কিন্তু অর্জুনপুরে সন্ধের পর বাড়ির বাইরে যেতেই ভয় করে তার। মনে হয়, এই বুঝি কেউ এল। সাদা কাপড়ে ঢাকা কঙ্কাল।
বোনকে পাশে শুইয়ে এক-এক দিন কলকাতার গল্প করে অমল। সেখানে হাজার হাজার মানুষ। যে দিকে তাকাও, শুধু মানুষ হাঁটছে চলছে। গাড়ি বলো, বাড়ি বলো, দোকান-বাজার বলো সবই হাজারে হাজারে। এক-একটা বাড়ি কী! ইয়া উঁচু! কত তলা নীচ থেকে গোনাই যায় না। একদম গুলিয়ে যায়। ঠিক সিনেমায় যেমন দেখায়, তেমন। রাতে? আলোয় ঝলমল। রাত্রি বারোটা-একটা পর্যন্ত পথে পথে জনসমাগম।
রাখী শোনে আর ভাবে, কবে যাবে সে, কবে দেখবে। অমল বলে, ‘তার ওপরে পাতালরেল। প্রথম যে দিন চাপলাম রে রাখী, উঃ, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। চলন্ত সিঁড়ি। চকচকে প্ল্যাটফর্ম। ট্রেনের মধ্যে এসি। গরমের দিনে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি! ভাবতে পারিস! অন্ধকার ভূগর্ভে যখন ঢুকল...।’
এই গল্প অমল অনেক বার করেছে। প্রত্যেক বার রাখী সাগ্রহে শুনেছে। শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গেছে। তবু আশ মেটে না। অমল বলে, ‘অলকদার দোকানের উল্টো দিকের রাস্তাতেই তো ভূগর্ভ রেলের স্টেশন। আর দোকানের একেবারে মাথার ওপর রেলের লাইন।’
রাখী জেনে গেছে, গড়িয়ার দিকে ভূগর্ভ রেল যায় মস্ত মস্ত খুঁটির ওপর পাতা লাইন দিয়ে। টালিগঞ্জে তা গুহায় ঢুকে যায়। বেরোয় গিয়ে সেই দমদমে। এ নিয়ে তার কৌতূহলের শেষ নেই। অমল সব কথার জবাব দিতে চেষ্টা করে। কলকাতা নিয়ে তার নিজের বিস্ময়েরও অবধি নেই। রাখী বলে, ‘আমাকে নিয়ে যাবি মেজদা?’
অমল বলে, ‘যাব। মাকেও নিয়ে যাব। মা’র খুব ইচ্ছা কালীঘাটে পুজো দেয়।’
উদ্যোগ অমলেরই। শোনার পর থেকে কমলের উৎসাহও কম নেই। গৌরী বলল, ‘তোদের মাসিকে এক বার বললে সে যেত।’
কমল ছুটল মাসির বাড়ি গোসাবা। মাসি পার্বতীর বাড়িতেই ছিল কমল-অমলদের দিদিমা ফুলিরানি। সে ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, ‘ও মা! আমার কত দিনের ইচ্ছে। আমাকেও নে চল বাবা।’
বুড়ি মানুষ, কবে আছে কবে নেই, কমল রাজি হল। অমলের কাছে খবর পেল পাখি। সে-ও যাওয়ার বায়না করল অলকের কাছে। অলক বলল, ‘যাবে ভাল কথা। বাচ্চা দেখবে কে। আমাকে তো দোকানে বসতেই হবে। সারাদিনের ব্যাপার। বাবা-মায়ের ওপর বাচ্চাদের চাপিয়ে তোমার যাওয়া ভাল দেখায় না।’
পাখির মুখটা করুণ হয়ে উঠল। অমলের চোখে পড়ল তা। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘দিদি বাচ্চাদের নিয়েই যাক না আমাদের সঙ্গে। আমরা এত জন আছি। সামলে নেব।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ উৎসাহে ঝলমলিয়ে উঠল পাখি, ‘ওদের নিয়েই যাব। তুমি না বোলো না গো।’
দল বেশ ভারী হয়ে দাঁড়াল। জিতু মণ্ডল যাবে না। সুবিমলও নয়। তবুও এ বাড়ি থেকে গৌরী, রাখী, কমল, অমল। ও-দিকে পার্বতী, পার্বতীর চোদ্দো বছরের ছেলে চঞ্চল, ফুলিরানি। এ-দিকে পাখি, পাখির দুই মেয়ে। মোট দশ জন। এর মধ্যে ভরসা এক অমল। কমল সমর্থ বলবান যুবক ঠিকই, তবে কলকাতায় সে বিশেষ অভ্যস্ত নয়।
অমল কমলের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করল। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়বে। গড়িয়া স্টেশনে নামবে। অটো করে চলে আসবে ভূগর্ভ রেলের স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরামে। সেখান থেকে ভূগর্ভ রেলে চেপে কালীঘাট স্টেশন ছাড়িয়ে নামবে যতীন দাস পার্কে। সেখান থেকে আবার অটো ধরে মন্দির এই একটুখানি। পুজো দিয়ে, দোকানে ভাল মতো খেয়ে-দেয়ে, আবার ভূগর্ভ রেলে চেপে যাবে ময়দান পর্যন্ত। ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ দেখে, সন্ধে নাগাদ একই ভাবে প্রত্যাবর্তন।
পরিকল্পনা দারুণ পছন্দ হল কমলের। কলকাতায় গিয়ে-গিয়ে কত স্মার্ট হয়ে গেছে অমল! একটু একটু ঈর্ষাও হল তার। তবে ভাল লাগা ঈর্ষা ছাপিয়ে গেল।
আর পরির মতো, প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে লাগল রাখী। স্কুলে বন্ধুদের বলল, ‘আমরা তো কলকাতায় যাচ্ছি। কালীঘাট, ভিক্টোরিয়া, ভূগর্ভ রেল।’ গ্রামের বন্ধুদের বলল। উদার আকাশকে বলল। বাগানের আম-কাঁঠালের গাছকে বলল। খেতের শস্যপ্রদায়ী গাছকে বলল। পথের ধারে আকন্দ, ভাঁট, শিয়ালকাঁটা, ঢেঁকি বা কচু ঝোপকেও বলতে ছাড়ল না। সবচেয়ে প্রিয় ফ্রকটি সে বার করে হাত বুলিয়ে রাখল। ক’দিন মায়ের হাতে হাতে খুব কাজ করল। গৌরী ভোরে ওঠে তো সে-ও ওঠে। গৌরী গোয়াল ঝাঁট দেয় তো সে উঠোন ঝেঁটিয়ে সাফ করে। ছোট ছোট হাত দু’টি দিয়ে সবজি কাটতে চায়। গৌরী সস্নেহে ছোট মেয়েটির দিকে তাকায়। তার চোখে পড়ে ধীরে ধীরে মুকুলিত হচ্ছে রাখী। সবার ছোট। সবার আদরের। দাদারা পারলে এখনও কোলে তুলে রাখে। আদরের আধিক্যে বাড়ির ছোটদের বড় হওয়ার বোধ জন্মায় দেরিতে। এই বয়সে পাখি এমন পাতলা জামা পরে দৌড়ে বেড়াত না। গৌরী কিছুই শিখিয়ে দেয়নি। পাখি আপনি বুঝেছিল। সে এক বার ভাবল, রাখীকে একটু সচেতন করে দেয়, নারীত্বের প্রথম বিকাশগুলি সম্পর্কে অবহিত করে। কিন্তু মেয়ের মুখের নিষ্পাপ শিশুসুলভ ভাব তাকে নিরস্ত করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও তার কনিষ্ঠতম সন্তানের শৈশব লালন করতে চায়। ভাবে, যাক আর ক’দিন। সময় হোক।
যাওয়ার আগের দিন, সোমবার, সব্বাই জমা হল অর্জুনপুরে। ভোর চারটেয় উঠে স্বামী ও ছোট ছেলের জন্য রাঁধতে বসল গৌরী। পার্বতী তাকে সাহায্য করতে লাগল। রাখী নিজেই গেল গোয়াল সাফ করতে। পাখি মেয়েদের খাবার-দাবার গোছগাছ করতে লাগল। আলো ফুটলে স্নান সেরে সকলে যে-যার মতো সাজতে বসল। কমল-অমল পরল জিনস আর শার্ট। গৌরী আর পার্বতী দু’জনেই সিল্কের শাড়ি পরল। কবেকার এই শাড়ি। দুই বোনেরই মাত্র একটি করে। পার্বতীর বর নিতাই বড় ছেলের জন্মের পর খুশি হয়ে কিনে দিয়েছিল। শাড়ি পরতে পরতে পার্বতী বলছিল নিতাইয়ের কত আসার ইচ্ছে ছিল। কাজ ফেলে আসতে পারল না। বড় ছেলেটা একটু ঘরকুনো। কোথাও যেতে চায় না। গৌরী প্রশংসা করল। কত ভাল শাড়ি দিয়েছিল নিতাই। এখনও নতুনের মতো আছে। বছর আঠারো তো হবেই। ফুলিরানি নিতাইয়ের প্রশংসা শুনে বড় জামাই জিতুর প্রশস্তি করল। সে হল ভোলা মহেশ্বর। জিনিসপত্রে ঝোঁক নেই।
পাখি সাজগোজ করছিল। বলল, ‘তোমরা সিল্ক পরলে মাসি? গরম লাগবে যে!’
গৌরী-পার্বতী হেসে অস্থির। গরম যে লাগবে, তা কি জানে না? তবু, এ শাড়ি পরার সুযোগ জোটে কই! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুতির ছাপা শাড়িতেই জীবনের উৎসবগুলি পার করে দেওয়া গেছে।
মেয়েদের সাজগোজ হল কি না দেখার জন্য অমল এ-ঘরে উঁকি দিয়েছিল। মাতব্বরি চালে বলল, ‘কীসের গরম! আজ তোমাদের এসি রেলে চড়াব।’
ফুলিরানি বলে, ‘সে আবার কী!’
‘বুঝবে বুঝবে।’
রাখী তার প্রিয় ফ্রক পরে চুল আঁচড়ে এসে দাঁড়াল। পাখি বলল, ‘এ কী রে! বেড়াতে যাচ্ছিস কলকাতায়, চোখে একটু কাজল দে।’
রাখী দু’হাতে মুখ ঘষে বলল, ‘ওঃ। আমি পরি না। আমার নেই।’
পাখি হাসল। বলল, ‘বোস দেখি এখানে। তোকে একটু সাজিয়ে দিই।’
বড় মেয়ের রঙিন ক্লিপের সম্ভার থেকে একজোড়া নিয়ে সে লাগিয়ে দিল বোনের চুলে। চোখে পরিয়ে দিল মোটা কাজল। ভুরু এঁকে দিল। ঠোঁটে গাঢ় রং। একজোড়া কাচের দুল পরিয়ে দিল কানে। ফ্রক পরা বালিকা শরীরের ওপর শিশুসুলভ মুখে যুবতীসুলভ রূপটান।
পাখি বোনের চিবুক তুলে বলল, ‘বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে!’ সে নিজেও সাজল চড়া রকম। রাখী এক ঝলক আয়নায় নিজেকে দেখে ছুটল সুবিমলের কাছে। বলল, ‘দ্যাখ দ্যাখ, দিদি সাজিয়ে দিয়েছে।’ অমল, কমল ওখানেই ছিল। অমল বলল, বাঃ চমৎকার। কমল বলল, সুন্দর। সুবিমল বলল, ‘দিদি করে দিয়েছে। ভাল। তবে আমার রং-চং ছাড়া এমনি ভাল লাগে।’ রাখী একটু নিভে গেল। কিন্তু এ-সব নিয়ে আর ভাবার সময় নেই। সব্বাই তৈরি। দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা হল। |
২ |
ট্রেন থেকে যতক্ষণ দেখছিল, সে এক রকম। প্ল্যাটফর্মে নেমে হাঁ হয়ে গেল রাখী। চারিদিকে কেবল বাড়ি, কেবল গাড়ি আর মানুষ। তাও, অমল বলেছে, গড়িয়া তেমন কলকাতা নয়। এখনও ফাঁকা জমি পুকুর বিস্তর আছে। বহুতল তো নেই-ই প্রায়। ওই দূরে যা দেখা যায়। রাখীর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। কিন্তু জবাব দেবে কে। দু’টি বাচ্চা, এক জন বুড়ি আর তিনটে আনাড়ি মহিলা সামলাতে অমল ব্যতিব্যস্ত। তার কোলে পাখির বড় মেয়ে। কমলের কোলে ছোট মেয়ে, মেয়েদের ব্যাগ। ফুলিরানির এক হাত ধরে চঞ্চল, অন্য হাতে রাখী। গড়িয়া স্টেশন থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম ভূগর্ভ রেল স্টেশনে যখন পৌঁছল তারা, রাখীর বুক ঢিবঢিব করতে থাকল উত্তেজনায়। দেখছে, সব নিজের চোখে দেখছে সে এখন! ওই চলন্ত সিঁড়ি, খুঁটির মাথায় রেলের লাইন, সব সব।
চলন্ত সিঁড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়াল সব। কিছুতেই উঠবে না। অবশেষে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা।
বেলা সাড়ে এগারোটা। অমল বলেছিল এ সময় লোকজন কমে আসে। এই স্টেশন থেকে
রীতিমতো ফাঁকা ট্রেন পাওয়া যাবে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে তারা হাঁ হয়ে গেল। এ যে অনেক লোক! থই-থই করছে। অমল হতবুদ্ধি। সে একে-তাকে
প্রশ্ন করে জানল, যান্ত্রিক গোলযোগে ট্রেন বন্ধ ছিল অনেকক্ষণ। এখন চালু হয়েছে, তবে সংখ্যায় কম। সে পই-পই করে সকলকে বোঝাতে লাগল
কী কী করণীয়। বার বার বলল সবাই যেন কাছাকাছি থাকে। সবাই যেন অমলের দিকেই
চোখ রাখে।
ট্রেন ঢুকছে। অমল খুশি হল। ট্রেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এটা ছাড়া যাবে না। পরেরটা এসি হয় কি না হয়! দলবল নিয়ে, একে গুঁতিয়ে, তাকে ঠেলে, ফুলিরানিকে জাপটে ট্রেনে উঠল সে। গায়ে গা লাগানো ভিড়ে তারা দাঁড়িয়ে রইল আরও ঘনিষ্ঠ আরও নিবিড় আত্মীয় পরিচয়ে। বৃদ্ধদের আসনে পর্যন্ত ফুলিরানি বসার জায়গা পেল না। রাখী কোনওক্রমে একটা খুঁটি ধরতে পারল। ঠান্ডার পরিবর্তে ভেতরটায় দমবন্ধকর, গরম। বড় বেশি ঠাসাঠাসি। এমন দমচাপা ভিড়ের কথা অমল এক বারও বলেনি। তবু, প্রথম কলকাতা, প্রথম পাতাল রেল, প্রথম এমন বেড়ানো। লোকজনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বাইরে যতটুকু দেখা যায় মোহিত হয়ে দেখছিল সে। একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে। লোক উঠছে। ভিড় বাড়ছে। মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে ট্রেনটা অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করল। |
|
একটি হাত, কর্কশ, শক্ত, বার বার আসছে। রাখীর গলায়, পিঠে, বুকে। হাত বুলোচ্ছে। চাপ দিচ্ছে। শক্ত তীক্ষ্ণ কিছু ঠেকছে পিঠে। রাখীর বিশ্রী লাগছে! ভয় করছে! কেন সে জানে না। এমন অদ্ভুত স্পর্শ সে কখনও পায়নি। সে ভাবছে মাকে ডাকবে, পারছে না। সে নড়ে দাঁড়াল। হাতটা সরে গেল। কী চায় এ হাত! তার গায়ে আসছে কেন! গরমে, ভয়ে, অসহ্য স্বস্তিহীনতায় সে ঘেমে ভিজে উঠল। কানে এল মা-মাসি-দিদি অনর্গল কথা বলছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু পরেই ওই হাত ফিরে এল পশ্চাদ্দেশে। রাখীর গা ঘিনঘিন করে উঠল। কিন্তু কী যেন এক আতঙ্কে সে বিহ্বল। পাপবোধে কাঠ। অন্ধকার গুহায়, গাড়ির মিটমিটে আলোয়, হাজার লোকের মধ্যে, এই প্রথম রাখীর মনে হল, তার ভীষণ বিপদ।
অসহায়তার বোধ এই প্রথম। পাপ বোধ এই প্রথম। নোংরা বিশ্রী গা ঘিনঘিনে। প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, ঝলমলে, প্রগতিশীল কলকাতায় এই প্রথম।
রাখী কেঁদে ফেলল। অনেকটা আর্তনাদের মতো। কমল কাছাকাছি ছিল। সে শুনে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাখী, এই রাখী! কী হল!’ হাতটা সরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। শিশুসুলভ সারল্য আরও কিছু কাল রক্ষা করার মায়ায় মা গৌরী তাকে যে প্রাথমিক ধারণাটুকুই দিতে পারেনি, জগৎ তার শোধ তুলল নির্মম কর্কশ ঘৃণ্য অমানুষী প্রক্রিয়ায়। তার রং মাখা ঠোঁটের ব্যাদান সুন্দর ছিল না। মোটা কাজল পরা চোখ থেকে ঝরা জল তাকে দ্রষ্টব্য করল। এক ভদ্রলোক তা দেখলেন। রাখীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কী হল মা? ব্যথা পেয়েছ?’
রাখী জল ভরা চোখে তাকাল। কোনও কথা বলল না। কমল ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে চাইল, পারল না। ভদ্রলোক আবার বললেন, ‘লেগেছে?’ রাখী এ বার অল্প মাথা নাড়ল। কেন, সে জানে না। ভদ্রলোক পরম মমতায় বললেন, ‘আহা রে!’ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রাখী ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল এই আতঙ্কের সঙ্গে, হাতটা মাথা থেকে নীচের দিকে নামবে না তো! পৃথিবীতে আরও একটি মেয়ে এমন সন্ত্রাসকবলিত হল যা তাকে কোনওদিন ছাড়বে না। আকাশে ওড়ার অমল স্বাদ পাওয়ার আগেই দুমড়ে-মুচড়ে গেল ছোট্ট পরির দুটি ডানা।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|