|
|
|
|
|
|
|
ছেনি, হাতুড়ি, বন্দে মাতরম |
ঘটনা হোক বা রটনা, হলওয়েল মনুমেন্ট সহসা এক আন্দোলনের কেন্দ্রে।
আন্দোলনের নেতৃত্বে সুভাষচন্দ্র বসু।
শেষ পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে সরানো হল সেই স্তম্ভ।
দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে বাকি ইতিহাস পড়ছেন গৌতম চক্রবর্তী।
|
দুশো টাকা দেবেন? তার কমে হবে না,’ দোকানে টাঙানো ডেনিম ট্রাউজার্স নামাতে নামাতে বলল ছেলেটি।
সস্তা জামাকাপড়, ডায়ারি, মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ, ক্যাসেটের দোকানে ছয়লাপ লেনিন সরণির ফুটপাথ। বাস ধরতেও দাঁড়ানোর জো নেই। মৌলালি, ওয়েলিংটনগামী বাসগুলি ওভারটেক করার নেশায় প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়ছে, যানজটের মধ্যেই টিং টিং ঘণ্টি বাজিয়ে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাম।
গোবিন্দপুর গ্রামে নতুন ফোর্ট উইলিয়মের কাজ চলতে চলতেই ১৭৭০ সাল নাগাদ এসপ্ল্যানেড অঞ্চলটি তৈরি হয়। এটিই দুর্গ এলাকার বহিঃসীমা। প্রায় আড়াই শতক পেরিয়ে এখন এই অঞ্চলটিই শহরের প্রধান এলাকা।
লেনিন সরণির এই ফুটপাথেই ‘শহিদ টিপু সুলতানের মসজিদ’। ১৮৪০ সালে টিপুর একাদশতম পুত্র গোলাম মহম্মদ মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। প্রধান ফটকের গায়েই মহম্মদ সইফুদ্দিনের জামাকাপড়ের দোকান। জামাকাপড়ের আড়ালে চোখে পড়ে না, কিন্তু সইফুদ্দিন দেখিয়ে দিলেন, দেওয়ালে ফার্সি ভাষায় লেখা এক প্রস্তরফলক। ‘‘আগে আরও একটা ছিল। কিন্তু সত্তরের দশকে আগুন লেগে ফলকটা নষ্ট হয়ে যায়,’’ বলছিলেন সইফুদ্দিন।
ফার্সি ভাষার এই দুই ফলকের সঙ্গে ছিল একটি ইংরেজি ফলক: কোম্পানির ডিরেক্টরেরা ভাতার সঙ্গে বকেয়া টাকা দেওয়ায়, ১৮৪০ সালে গোলাম মহম্মদ এই মসজিদ নির্মাণ করলেন। গোলাম মহম্মদ পরে নাইট উপাধিতে সম্মানিত হন। যাদবপুরের কাছে আজও তাঁর নামে রাস্তা আছে।
মসজিদটি গোলাম মহম্মদ ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে। গোলাম মহম্মদ তথা টিপু সুলতানের বংশধর আনোয়ার আলি শাহ এখনও এস্টেটের অফিসে এসে বসেন। “হেরিটেজ বিল্ডিং, রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা চলছে,” বলছিলেন তিনি। ওঁর বিখ্যাত পূর্বসূরি অবশ্য কলকাতায় আসেননি। বহু দূরে, মহীশূরের কাছে শ্রীরঙ্গপত্তনম-এ ১৭৯২ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন টিপু সুলতান।
অতঃপর ইংরেজরা টিপুর স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠায়। গোবিন্দপুরের দক্ষিণে ‘রসাপাগলা’ গ্রামে তাঁরা অন্তরিন ছিলেন। রসাপাগলা আজ অন্য ভাবে চিনতে হবে। ‘সাউথ সিটি’র অদূরে যে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজ, সেটিই ছিল টিপুর বংশধরদের খাসমহল। প্রাসাদে ঢুকতে হত টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিক থেকে। ঘড়ি-লাগানো, দেউড়িওয়ালা সে বাস স্টপের নাম আজও ঘড়িঘর!
টিপু ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছেন, আর তাঁর ছেলে গোলাম মহম্মদ ইংল্যান্ডে গিয়ে নাইট উপাধি পাচ্ছেন! ‘জেনারেশন গ্যাপ’ দিয়ে এর ব্যাখ্যা হয় না। কলকাতায় তখন ইউরোপীয় বণিক ও সম্ভ্রান্ত দেশজ লোকেদের সঙ্গে মেলামেশায়, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, খবরের কাগজের হাত ধরে তৈরি হচ্ছে এক ‘নাগরিক সমাজ’। গোলাম হোসেন থেকে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর সকলে সেই নতুন সমাজের উদাহরণ!
সেই সমাজ সাম্রাজ্যের অবদান!
|
সাম্রাজ্যের গতিবিধি |
পলাশির যুদ্ধের মাত্র এক দশক পরে ১৭৬৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় টাকা খাটতে শুরু করে। সে বার পার্লামেন্ট সদস্যদের ২৩ শতাংশই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশীদার। আজ ভারতীয় সংসদে ‘চিনি লবি’, ‘পাম অয়েল লবি’ ইত্যাদি নানা ক্ষমতাগোষ্ঠীর কথা শোনা যায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবিই আসল। আর, পার্লামেন্টের প্রশ্রয়ে, কোম্পানির ডিরেক্টরেরা তখন এমন আর্থিক জালিয়াতি শুরু করেন যে, ১৭৭২ সালে লন্ডনে প্রায় এক ডজন ব্যাঙ্ক লালবাতি জ্বালতে বাধ্য হয়। রজত গুপ্ত আজকের ব্যাপার নয়।
এটাই লন্ডনের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। কোম্পানির হাতে আসা জায়গাগুলিতে যথাযথ বাণিজ্য চালাতে হবে। পলাশির পর ইংল্যান্ডে ক্লাইভ প্রায় নায়ক বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের পরের বছরই, ১৭৭৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলার কোষাগার থেকে ২ লক্ষ ৩৪ হাজার পাউন্ড সরানোর অভিযোগ আনা হল। পার্লামেন্টে আত্মপক্ষ সমর্থনে ক্লাইভের বক্তৃতা আজও মনে রাখার মতো, “ভাবুন, পলাশির জয় আমাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছিল! আমার দয়ার ওপর নির্ভর করে রয়েছে ধনাঢ্য এক শহর। সেখানকার ব্যাঙ্কাররা আমাকে তুষ্ট করতে সোনাদানা, রত্নের ভল্ট খুলে দিয়েছে। মিস্টার চেয়ারম্যান, আমার পরিমিতিবোধের কথা ভেবে এখনও অবাক হয়ে যাচ্ছি।” কিন্তু ক্লাইভ যা-ই বলুন, ঠিক হল, এ বার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর সরকারি নজরদারি থাকবে। ব্রিটিশ সরকার এক জনকে গভর্নর জেনারেল মনোনীত করবে, পার্লামেন্টের সম্মতিসাপেক্ষে।
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। ১৭৮৪ সালে দেশে ফেরার পর পার্লামেন্টে তাঁকেও দাঁড়াতে হল ইমপিচমেন্টের মুখে। ১৮৪ দিন সওয়াল জবাব চলেছিল, “ভারতকে আমরা ছিবড়ে করে ছেড়ে দিয়েছি। ইংল্যান্ড সেখানে রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল, ব্রিজ, গির্জা কিছুই বানায়নি,” হেস্টিংসকে আক্রমণ করেছিলেন এডমন্ড বার্ক।
ভারতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল, হাসপাতাল, প্রশাসনিকতা তৈরির চিন্তা এসে গিয়েছে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে। কারণটা সহজ। মাত্র ছয় বছর আগে ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, ব্রিটেনের কবল থেকে আস্ত একটি উপনিবেশ ছিটকে গিয়েছে। অতএব ‘লুক ইস্ট’।
পুবের দিকে তাকাতে গিয়েই বদলে গেল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক দর্শন। আগে বলা হত, যে লোকটি কষ্ট করে ফসল ফলায়, জমিতে তারই অধিকার। আমেরিকার আদিবাসীরা পশুপালন করে, ফসল ফলায় না। ফলে এই দর্শনের বলে সেখানে জমি দখল করে উপনিবেশ তৈরি করা যায়। কিন্তু ভারতে লোকজন ফসল ফলায়, বহু আগে থেকেই কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যে স্বয়ম্ভর সভ্যতা।
নতুন রাজনৈতিক দর্শন তাই অন্য যুক্তি তৈরি করল। বলা হল, প্রাচ্যের নৃপতিরা স্বৈরাচারী। সে দেশে আইন, প্রশাসন বলে কিছু নেই। তাই গড়তে হবে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তা। স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে আরও বেশি মানুষ আরও বেশি সুখে থাকবে। ভারতীয়দের স্বার্থেই ব্রিটিশ শাসন জরুরি।
নতুন দর্শনের প্রভাব যে কী সাংঘাতিক! প্রশাসনিকতা তৈরির খাতিরে হলওয়েলের ‘ব্ল্যাক হোল’ কাহিনিটিও সাম্রাজ্য আর খায় না। ১৮১৭ সালে ইতিহাসবিদ জেমস মিল উল্টে নিজেদেরই দায়ী করে লিখবেন, ‘সিরাজ ‘ব্ল্যাক হোল’ কারাগার বানাননি। পুরনো দুর্গে ওই ব্ল্যাক হোল ইংরেজরাই তৈরি করেছিল। মানে, কারাগারে অত্যাচার চালানোর ব্রিটিশ নিয়ম কলকাতায় রফতানি হয়েছিল।’
এই পরিবেশে, কাউন্সিল হাউসের কাছে হলওয়েলের শহিদস্তম্ভ আর গুরুত্ব পায় না। রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, উল্টে সেটি ভবঘুরেদের আস্তানা। ১৮২১ সালে স্তম্ভটা তাই তুলে ফেলা হল।
|
দুই বাঙালি |
অষ্টাদশ শতকে ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকেই শুরু হয়ে গেল খবরের কাগজের উৎপাত। প্রথমে জেমস অগাস্টাস হিকি নামে এক আইরিশের ‘হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট’। তার পর ‘বেঙ্গল জার্নাল’, ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ ইত্যাদি হরেক কাগজ। বেশির ভাগই কোম্পানির বিরুদ্ধে কলম চালায়। বক্তব্য, শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নয়, প্রতিটি ইংরেজ অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। কলকাতার প্রথম কাগজের সম্পাদক হিকিকে হেস্টিংস জেলে পুরেছিলেন, তাঁর মুদ্রণযন্ত্রও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
কিন্তু তৈরি হচ্ছে নতুন নাগরিক সমাজ। সেখানে রামমোহন, দ্বারকানাথ, মতিলাল শীলের মতো অনেকেই অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে। তাঁরা ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসা করছেন, কাগজের মালিকানা নিচ্ছেন, নিজের মত জানাচ্ছেন। এগিয়ে এসেছেন ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে।
আর এখানেই ‘ব্ল্যাক হোল অব দ্য এম্পায়ার’-এর নতুন তত্ত্ব। নবজাগরণ বা জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের সূচনায় রামমোহনকে রেখে যে সরলরেখা টানা হয়, সেই ধারণাটা ভুল। ওই সময়টিকে বরং ‘আধুনিকতার সূচনা’ বা ‘আর্লি মডার্নিটি’ বলা উচিত। পরবর্তী আধুনিকতার সঙ্গে এই ‘সূচনার আধুনিকতা’র অনেক তফাত আছে। কী তফাত?
প্রশ্ন: সূচনার আধুনিকতা ব্যাপারটা ঠিক কী? এ দেশের শিল্প, কৃষি যখন ধ্বংস হচ্ছে, রামমোহন ব্রিটিশ বিনিয়োগ সমর্থন করছেন। তা হলে ওঁকে আধুনিক বলছেন কেন?
পার্থ: আধুনিকতা সব সময় এক ভাবে, এক রাস্তায় আসে না। রামমোহন, দ্বারকানাথরা বাণিজ্যে বিশ্বাসী। তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছাড়া অন্য বণিকদের সঙ্গেও ব্যবসা করছেন। সূচনার আধুনিকতা অবাধ বাণিজ্যে ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। উপনিবেশের আদি যুগে এটি দ্রুত তৈরি হয়, কিন্তু জাতীয়তাবাদী আধুনিকতার চাপে অচিরে মারা যায়।
প্রশ্ন: কী রকম?
পার্থ: জাতীয়তাবাদী আধুনিকতা এই ‘সূচনার আধুনিকতা’কে পছন্দ করে না, একে ব্যবসায়ী, সাম্রাজ্যের সহযোগী, অগণতান্ত্রিক ইত্যাদি মনে করে। ‘সূচনার আধুনিকতা’ আর ‘জাতীয়তাবাদী আধুনিকতা’, এই দুই পর্বকে আলাদা করা যায়নি বলেই আজ জাতীয়তাবাদ গুরুত্ব পায়, দ্বারকানাথ, রামগোপাল ঘোষদের বাণিজ্যের ইতিহাস হারিয়ে যায়। |
নতুন শহিদস্তম্ভ |
লর্ড কার্জনের সৌজন্যে হলওয়েল স্তম্ভ নতুন সাজে শহরে ফিরে এল ১৯০২ সালে। তার কয়েক বছর আগে, ১৮৮৮ সালে আলিপুর টাঁকশালের অফিসার হেনরি এলম্লি বাস্টিড ‘ইকোজ ফ্রম ওল্ড ক্যালকাটা’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই অন্ধকূপ নিয়ে বিশদ কাহিনি। লেখকের দুঃখ একটাই। ‘শহরের যে স্তম্ভ সংরক্ষণ প্রতিটি ইংরেজের ব্যক্তিগত দায়িত্ব ছিল, তা আজ ধুলোয় মিশে গিয়েছে।’
দশ বছর পর, ১৮৯৮। ভারত মহাসাগর বয়ে চলা ‘অ্যারাবিয়া’ জাহাজের কেবিনে বসে বাস্টিডের বইটি পড়ছেন ৩৯ বছরের স্বল্পকেশ এক ইংরেজ। অক্সফোর্ডের স্নাতক, ইতিহাসে উৎসাহী। এত বড় ঘটনার স্মৃতিস্তম্ভ নেই? বইটা পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগল তাঁর মনে। ভদ্রলোক ভারতে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নিতে চলেছেন। নাম জর্জ কার্জন।
বঙ্গভঙ্গ নামে একটি তুচ্ছ ঘটনার দৌলতে লর্ড কার্জন বাংলার ইতিহাসে প্রায় খলনায়ক। কিন্তু ঘটনা হল, কার্জন না থাকলে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের এই রমরমা হত না। ধ্বংসস্তূপ থেকে সাঁচী, অমরাবতী, খাজুরাহোর নবজন্ম হত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনেট, সিন্ডিকেট হত না। তিনি না থাকলে হত না ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও!
হলওয়েলের মনুমেন্টের আদলে ডালহৌসি স্কোয়ারে নতুন স্তম্ভ বসিয়েছেন কার্জন। লন্ডনের এক সংস্থা সিসিলি-র মার্বেল পাথরে স্তম্ভটি তৈরি করে জাহাজে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। বিশ শতকের শুরুতে সেটিই কলকাতার নতুন মিনার।
ব্ল্যাকহোলের নয়া ইতিহাসকারের কাছে তাই প্রশ্নটা পেশ করতেই হল।
প্রশ্ন: কার্জন অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল আর ভাইসরয়দের ১৫ জনই অক্সফোর্ডের স্নাতক। ৫ জন কেমব্রিজ। অক্সফোর্ড তা হলে কেমব্রিজের চেয়েও বেশি সাম্রাজ্যবাদী ছিল?
পার্থ: কেমব্রিজে সিলেবাসের আধুনিকীকরণ হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদিতে গুরুত্ব দেওয়া হত। কিন্তু অক্সফোর্ড গুরুত্ব দিত গ্রিস, রোমের ইতিহাসে। গ্রিক সাহিত্যের পণ্ডিত বেঞ্জামিন জোয়েট তখন বেলিয়ল কলেজের মাস্টার। গর্ব করে বলতেন, আমি যে ভাবে গ্রিস, রোম পড়াই, তাতেই আমার ছাত্ররা উপনিবেশ শাসনের শিক্ষা পায়।
|
মহমেডান! মহমেডান! |
গো-ও-ল! হিপ হিপ হুররে! নাচতে নাচতে ঘরে ফিরছে মহমেডান স্পোর্টিং-এর সমর্থকেরা। ফুটবল এখন কলকাতার জনপ্রিয়তম খেলা, ১৯১১ সালেই মোহনবাগান দল ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে ২-১ গোলে হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জিতেছিল!
তার পর আড়াই দশক অতিক্রান্ত। ১৯৩৮ সালে টিম একটাই। মহমেডান স্পোর্টিং। শুধু বাংলা নয়, কোয়েটা, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে তুখড় মুসলিম খেলোয়াড়দের জড়ো করেছে এই ক্লাব। নেট ফল, ’৩৪ সাল থেকে টানা পাঁচ বার লিগ জয়, গত বছর আই এফ এ শিল্ড! মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো খালি পায়ে নয়, এই ক্লাব বুট পায়ে খেলে। শুধু শহরের মুসলিমরা নন, পূর্ববঙ্গ ও অসম থেকে আসা মুসলমান ছাত্ররা চার আনার গ্যালারিতে ভিড় জমায়। চটকলের ম্যানেজারেরাও মুসলিম শ্রমিকদের মাঠে যেতে উৎসাহ দেন। মাইনে বাড়ানোর দাবিদাওয়া থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে ফুটবল অব্যর্থ দাওয়াই!
বাংলায় তখন ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগের জোট মন্ত্রিসভা। ইতিমধ্যে একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এক নিবন্ধে মুর্শিদাবাদের স্কুলশিক্ষক জেম্স লিটল লিখেছেন, ‘ব্ল্যাক হোলের ঘটনাটি আস্ত ধাপ্পা।’ ১৯১৬ সালের ১৬ মার্চ ক্যালকাটা হিস্টরিকাল সোসাইটির সভায় এই নিয়ে বিতর্ক ডাকা হল। এক দিকে লিট্ল ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। বিপক্ষে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক এডওয়ার্ড ওটেন: “লিট্ল-এর বক্তব্যে সারবত্তা নেই।”
ওটেন জানতেন না, দর্শকাসনে বসে তাঁরই এক ছাত্র। এক মাস আগে, সেই ছাত্রের নেতৃত্বে কলেজে নিগৃহীত হয়েছেন তিনি, পরের দিনই ছাত্রটিকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্রের নাম সুভাষচন্দ্র বসু!
দুই দশক পর মহমেডান স্পোর্টিং-এর জয়োল্লাসের সময় সেই সুভাষই বাংলার জনপ্রিয়তম নেতা। দেশের সর্বস্তর থেকে এখন ব্রিটিশ শাসন হঠানোর তোড়জোড়। ‘মুসলিম রেনেসাঁস সোসাইটি’ মহমেডানের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন হবিবুল্লা বাহারের নেতৃত্বে ১৯৩৯ সালের ৩ জুলাই সিরাজদৌল্লা দিবস পালনের ডাক দিয়েছে। তাদের দাবি, সিরাজকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। হঠাতে হবে হলওয়েল মনুমেন্ট!
লুফে নিলেন কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে-আসা সুভাষ। জানিয়ে দিলেন, আগামী সিরাজউদ্দৌলা দিবসে হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙা হবে। হিন্দু, মুসলিম, কমিউনিস্ট নির্বিশেষে ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলি উত্তাল সেই ডাকে। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাও মনুমেন্ট সরানোর কথা ভেবেছিল। কিন্তু তাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছিল অন্য এজেন্ডা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নাকচ করে গ্রামের কৃষককে কী ভাবে জমিদার আর মহাজনের ঋণ থেকে মুক্তি দেওয়া যায়! ফজলুল হক বললেন, মাসের শেষে সরকার মনুমেন্ট সরানো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সুভাষ অনড়, ‘কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটি ফজলুল হক জানাননি। আর সিদ্ধান্ত নিতে ২৪ ঘণ্টার বেশি লাগবে কেন?’ কৃষকের ঋণ নয়, বরং ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে মনুমেন্ট সরানোর দাবিতেই তো বেশি লোক টানা যাবে।
আন্দোলনের শক্তিতে ভীত ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করল সুভাষকে। কিন্তু জনতার রোষ কি বাধা মানে! সুভাষ জেলে। বিকেলে অফিসফেরতা লোকজন ডালহৌসি স্কোয়ার বেয়ে বাড়ি ফেরে, আর সেই ভিড় থেকে দশ-পনেরো জন হঠাৎ ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান দিতে দিতে হলওয়েল মনুমেন্টের দিকে ছুটে যায়। ফজলুল হক বিরক্তি জানালেন, ‘মনুমেন্ট সরিয়ে নেওয়া উচিত। কিন্তু যুদ্ধের সময় এই সত্যাগ্রহ সরকার বরদাস্ত করতে পারে না।’ জনমুখী রাজনীতি কবেই বা প্রশাসনের কথায় কান দিয়েছে? স্তম্ভ সরানোর দাবিতে জোটসঙ্গী মুসলিম লিগের ছাত্র সংগঠন এক সকালে পার্ক সার্কাসে ফজলুল হকের বাড়ি ঘেরাও করল। পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতিতে আহত হলেন কয়েক জন ছাত্র। শেষ অবধি ১৯৪০ সালের ২৩ জুলাই ফজলুল হকের ঘোষণা, সরিয়ে নেওয়া হবে স্তম্ভ। অতঃপর ডিসেম্বর মাসে, শহরের প্রাণকেন্দ্র ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে স্তম্ভটি উঠিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেন্ট জনস গির্জায়।
প্রশ্ন: সুভাষই কি বাংলায় পপুলিস্ট রাজনীতির পথিকৃৎ? সুগত বসুও ‘হিজ ম্যাজেস্টি’স অপোনেন্ট’ বইয়ে হলওয়েল মনুমেন্ট আন্দোলন নিয়ে মাত্র কয়েক লাইন লিখেছেন...
পার্থ: পপুলিস্ট রাজনীতি গাঁধীও করেছেন। বিশ শতকের ওই সময়টায় রাজনীতির ভাষা বদলাচ্ছে।
|
শেষ কথা |
ওই দেখুন, জোব চার্নকের সমাধি। বর্ষায় ভিজে ঘাস মাড়িয়ে হেঁটে গেলেই আট কোনা দোতলা সমাধি। ওপরে গম্বুজ। রাজভবনের উল্টো দিকে সেন্ট জন্স গির্জা চত্বরে আজও যে কত স্মৃতির ভিড়! সদর দরজায় পাশাপাশি দু’টি ফলক। একটিতে লেখা, ‘এই জমি দান করলেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর।’ পাশের ফলকে, ‘১৭৮৪ সালের ৬ এপ্রিল গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ওয়ারেন হেস্টিংস।’
গির্জার বাগানে এক পাশে দাঁড়িয়ে কার্জনের স্তম্ভ। হলওয়েলের তৈরি মনুমেন্টটি ১৮২১ সালেই হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে ৪৮ জন মৃতের নাম ছিল। কার্জনের এই মনুমেন্টে ৪৮ নয়, ৮১টি নাম। কেউ ভয়ঙ্কর সেই রাতে মারা গিয়েছেন। কেউ বা কিছু আগে-পরে। নামগুলি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই প্রশ্ন...
প্রশ্ন: মনুমেন্টে দেখলাম, স্টেয়ার ডালরিম্পল-এর নাম। উনি লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পলের পূর্বপুরুষ।
পার্থ: তাই? আমিও এমনটা শুনেছিলাম...
প্রশ্ন: গির্জার ভিতরে জেম্স কার্কপ্যাট্রিক-এর সমাধিফলক। ইংরেজ হয়েও মুসলিম মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। ওঁকে নিয়েই ডালরিম্পলের ‘হোয়াইট মুঘল্স।’ আপনি সাম্রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে এত লিখলেন, কিন্তু ব্রিটিশ ছেলে আর ভারতীয় মেয়ের ঘর বাঁধার কথা এড়িয়ে গেলেন?
পার্থ (হেসে): হোয়াইট মুঘলস? কার্কপ্যাট্রিক কিন্তু জীবন কাটিয়েছেন হায়দরাবাদে নিজামের দরবারে। হোয়াইট মুঘলস টাইপের ঘটনা সাম্রাজ্যের প্রান্তদেশে হায়দরাবাদে, রাজপুতানায় ঘটত। কলকাতার কেন্দ্রে নয়। প্রেম? জোব চার্নকের সমাধিতে দেখবেন, লাতিন ভাষায় শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেখানে ওঁর ভারতীয় স্ত্রীর নামটাও নেই। প্রেমের গল্পগুলি উপরিতলের। ভিতরে সাম্রাজ্য-উপনিবেশ, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-গরিব, পুরুষ-নারী ক্ষমতার কক্ষপথটা ঠিকই কাজ করত। ১৮৩০-৪০ নাগাদ তাই বলা হয়েছিল, সরকারি, এমনকী বেসরকারি কাজেও যে ব্রিটিশরা ভারতে যাবেন, তাঁরা ভারতীয় মহিলার সংসর্গ করতে পারবেন না।
প্রশ্ন: সাংঘাতিক তো!
পার্থ: সাংঘাতিক কিছু নয়। সাম্রাজ্য এ ভাবেই শাসক আর শাসিতের দূরত্ব বজায় রাখে। |
|
|
|
|
|