মায়ের মৃত্যুর পরে ভেঙে পড়েছিলেন কার্লো। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন মনের মধ্যে সযত্নে লালন করে আসছিলেন, বিমান চালিয়ে বিশ্ব-ভ্রমণের সেই স্বপ্নে মায়ের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই, ২০১০ সালের অগস্ট মাসে মা কার্লা চলে যাওয়ার পরে স্তিমিত হয়ে এসেছিল গরম রক্তের স্রোত।
একটি ইঞ্জিনের সেসনা বিমান নিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে নাগপুর থেকে কলকাতায় নামেন সেই কার্লো স্মিড। এখন তাঁর বয়স ২২ বছর। সবচেয়ে কম বয়সি পাইলট হিসেবে বিমান নিয়ে বিশ্ব-ভ্রমণে তাঁর কোনও রেকর্ড হল কি না তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই কার্লোর। তাঁর কথায়, “অনেক লড়াইয়ের পর স্বপ্ন সফল করতে পেরে আমি খুশি। এই ভ্রমণ মাকে উৎসর্গ করতে চাই।”
সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ লাগোয়া গ্রামে থাকেন কার্লো। ১১ জুলাই ছোট বিমান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বিশ্ব-ভ্রমণে। ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, ইজিপ্ট, সৌদি আরব, ওমান, পাকিস্তান ঘুরে ভারতের আমদাবাদে পৌঁছোন। সেখান থেকে নাগপুর ঘুরে কলকাতায়। বৃহস্পতিবার শহরের বিমানবন্দর লাগোয়া অখ্যাত হোটেলে বসে কার্লো বলেন, “এই ভ্রমণের জন্য পাঁচ লক্ষ মার্কিন ডলার জোগাড় করতে আমার জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে গিয়েছে। বলতে পারেন, কার্যত লোকের জুতো পালিশও করতে হয়েছে আমাকে! আমার তখন ১৮ বছর। সুইৎজারল্যান্ডে কে-ই বা আমাকে চেনে!” |
কবে থেকে শুরু এই স্বপ্নের?
কার্লো জানান, ছোট থেকেই স্বপ্নটা ছিল। ১৫ বছর বয়সে গ্লাইডিং শুরু করেন। পাখা লাগিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানোর সময়েই মেঘের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা বাড়ে। প্রশিক্ষণ নিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে জোগাড় করেন পাইলট লাইসেন্স। তার পর থেকে শুরু হয় বিমান নিয়ে বিশ্ব-ভ্রমণের তোড়ডোড়। গল্পের ছলে জানালেন, এর মাঝেই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে যান। বাবা জেরি স্মিড যখন শুনলেন বিশ্ব-ভ্রমণের কথা, তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, “তিন-চার মাসে এই ভূত তোমার মাথা থেকে চলে যাবে!” কিন্তু, সেই ভূত যায়নি। উল্টে বাবার সেই তির্যক মন্তব্য লক্ষ্যে পৌঁছতে আরও সাহায্য করেছে কার্লোকে। মা ছিলেন পাশে। বলতেন, “প্রস্তুতি নিয়ে যা। আমার বিশ্বাস তুই পারবি!”
কার্লো বলেন, “ওয়েবসাইট খুলে রোজ দেখতাম, কেউ হেলিকপ্টার নিয়ে, কেউ এক-ইঞ্জিনের বিমান নিয়ে, কেউ দুই ইঞ্জিনের বিমান নিয়ে বিশ্ব-ভ্রমণ করেছেন। ভাবতাম, ৪১ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারব তো? আমার তো তত অভিজ্ঞতাও নেই! কিন্তু, সাহসটা ছাড়িনি।” মায়ের মৃত্যুর পরে যখন ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে আসছিল স্বপ্ন, তখন পাশে দাঁড়ান বন্ধুরা। তাঁরাই উৎসাহ দিতে শুরু করেন। কার্লোর নামে ‘হোমপেজ’ খোলেন তাঁরা। কার্লোর ছবি ‘আপলোড’ করে মানুষকে জানাতে শুরু করেন তাঁরা। এগিয়ে আসে স্পনসর। ঠিক হয়, বিশ্ব-ভ্রমণ থেকে যে টাকা তুলবেন কার্লো তা ইউনিসেফ-কে দেওয়া হবে।
বন্ধুদের প্রতি তাই কৃতজ্ঞ কার্লো। বলেন, “একটা মজার ঘটনা বলি। ওমানের মাসকটে নামার পরে দেখি আমাদের দেশের কয়েকজন যুবক-যুবতী আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন! আমি তাঁদের আগে থেকে চিনতাম না। তাঁরা কর্মসূত্রে মাসকটেই থাকেন। সেই একটি রাতেই তাঁরা আমাকে বন্ধু বানিয়ে নেন। কী ভীষণ ভালো লেগেছে বোঝাতে পারব না। জীবনে বন্ধু-র যে কী প্রয়োজন, কী ভূমিকা তা প্রতি পদে অনুভব করছি।”
কলকাতায় নেমে সময়ের অভাবে শহর ঘুরে দেখতে পারেননি কার্লো। তবে বলে গেলেন, “প্রতিটি শহর সম্পর্কে আগে থেকে খোঁজ নিয়েছি। জেনেছি, আপনাদের শহরেও বন্ধুত্বের কদর রয়েছে। এখানে আড্ডা-র নাকি খুব চল। আমার কুর্নিশ রইল এই শহরের জন্য।” |