পর্দায় ছবি শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা ঘরে জরুরি বৈঠক করছেন নায়িকা অ্যান হ্যাথম্যান। হঠাৎ চার দিক থেকে গুলির আওয়াজ। অ্যান চমকে উঠলেন...
এই অবধি ঠিকই ছিল। তার পরই দর্শকাসনে কারও কারও মনে হতে লাগল, আওয়াজটা বড্ড বেশি সত্যিকারের মতো লাগছে না? কানের পর্দা ফেটে যাবে যেন! নাকি ছবিরই কোনও স্পেশ্যাল এফেক্ট? ভুল ভাঙল, কয়েক সেকেন্ডে। যখন নাকে এসে লাগল গ্যাসের কটু গন্ধ। আর সেই হতচকিত অবস্থার মধ্যেই লুটিয়ে পড়তে লাগল এক-একটা শরীর।
শিশু এবং মহিলা-সহ নিহত ১২। আহত-রক্তাক্ত ৫৯। অনেকের অবস্থাই সঙ্কটজনক। ঘটনাস্থল, আমেরিকার ডেনভার শহরে ‘সেঞ্চুরি ১৬’ মাল্টিপ্লেক্সের ৯ নম্বর স্ক্রিন। বৃহস্পতিবার মাঝরাতে ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’-এর প্রিমিয়ার শো চলছিল। ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজ-এর বহু প্রতীক্ষিত ছবিটি দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন আবালবৃদ্ধবনিতা। সেখানেই এলোপাথাড়ি গুলি চালাল বাস্তবের জমি ফুঁড়ে উঠে আসা এক ‘ডার্ক নাইট’।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, আততায়ীর পরনে ছিল আগাপাশতলা কালো পোশাক। মাথায় দাঙ্গা-পুলিশ যে ধরনের হেলমেট পরে থাকে, সেই হেলমেট। গায়ে বুলেটপ্রুফ জামা। চোখে গগলস্। |
তখনও আতঙ্ক। ডেনভারে। ছবি: এ পি |
কাকতালীয়ই হবে হয়তো! ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’-এর ঠিক আগে ‘গ্যাংস্টার স্কোয়াড’ নামে একটি ছবির ‘ট্রেলর’ দেখানো হচ্ছিল। সেখানে অবিকল এই ভাবে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে গুলি চালানোরই একটা দৃশ্য ছিল! কয়েক মিনিটের মধ্যে চোখের সামনে তার রি-প্লে’ ঘটবে, ভাবেনি কেউই।
মাল্টিপ্লেক্সের কার পার্কিং থেকেই কিছু ক্ষণ পরে সন্দেহভাজন হত্যাকারী হিসেবে যাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, তার নাম জেমস হোমস। বছর চব্বিশের যুবকটি বিনা বাধাতেই ধরা দিয়েছে। তার কাছে ছুরি, একটি পিস্তল ও একটি রাইফেল ছিল। প্রেক্ষাগৃহ থেকেও মেলে একটি বন্দুক। পুলিশের দাবি, জেমস জানিয়েছে, তার ফ্ল্যাটে প্রচুর বিস্ফোরক আছে। তাই উত্তর অরোরা এলাকায় তার বাড়িটি খালি করে দেওয়া হয়েছে। জানা গিয়েছে, জেমস পেশায় ‘ফিটনেস ট্রেনার’। কয়েক মাস আগে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো ডেনভার মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে পিএইচডি-র ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিল। জুন মাসে পড়া ছেড়ে দেয় সে।
জেমসের ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা আছে, ‘শান্ত থাকো! এগিয়ে চলো!’ কেন হঠাৎ বন্দুক নিয়ে মোট ৭১ জনকে গুলিবিদ্ধ করতে এগিয়ে এল সে? উত্তর এখনও মেলেনি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গি-যোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে। কলোরাডো-র এই অঞ্চলটি এমনিতে বেশ অপরাধপ্রবণ বলে পরিচিত। এখান থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৯ সালে একটি স্কুলে দুই ছাত্র গুলি চালিয়ে ১২ জন পড়ুয়া ও এক শিক্ষককে হত্যা করেছিল। ‘কলম্বাইন’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে সেই ঘটনা। তার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ নানা দেশেই বিভিন্ন সময় আচমকা হামলা চালিয়েছে বন্দুকবাজরা। তাদের কেউ কেউ মানসিক বিপন্নতার শিকার বলে পরে জানা গিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে মাল্টিপ্লেক্সের ৯ নম্বর ‘স্ক্রিন’-এ স্বাভাবিক ছন্দেই শুরু হয়েছিল সিনেমা। সাড়ে ১২টা নাগাদ দর্শকাসনের প্রথম সারির পাশে হলের আপৎকালীন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকে কালো মুখোশ পরা এক ব্যক্তি। প্রথমে গ্যাসের একটা শেল ফাটায় সে। তার পরেই শূন্যে একটা গুলি এবং ক্রমশ তা গুলিবৃষ্টির চেহারা নিল। এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, “দরজার কাছে ছিলাম। হামাগুড়ি দিয়ে কোনও মতে বাইরে এলাম।” রক্তাক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন আরও অনেকে। দেখতে পান, ভিতরে ঢোকার আগে লবিতেও গুলি চালিয়েছে আততায়ী। সেই শব্দই তাঁরা দর্শকাসনে বসে শুনেছিলেন, সিনেমার গুলিগোলা বলে ভুল করেছিলেন। লবিতে পড়ে ছিল মাল্টিপ্লেক্স কর্মীদের নিথর দেহ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ দিন ফ্লোরিডায় ছিলেন। নিজের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাতিল করে এক শোকবার্তায় তিনি জানান, কলোরাডোর ঘটনায় তিনি মর্মাহত। আজ, শুক্রবারই প্যারিসে প্রিমিয়ার হওয়ার কথা ছিল ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’-এর। অনুষ্ঠান বাতিল করেছে ছবির প্রযোজক ওয়ার্নার ব্রাদার্স-সহ শোকস্তব্ধ গোটা ইউনিট। প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ‘গ্যাংস্টার স্কোয়াড’-এর ট্রেলরও।
মাল্টিপ্লেক্সের ৯ নম্বর ঘরে সবাই দেখতে এসেছিলেন, বিপন্নদের বাঁচাতে ব্যাটম্যান কী ভাবে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন। অন্ধকার থেকেই আবির্ভূত হওয়া আততায়ী সব ওলটপালট করে দিল।
|
বন্দুকবাজের কবলে
|
১৩ মার্চ, ১৯৯৬ |
ব্রিটেনের ডানব্লেনের
প্রাইমারি স্কুল |
নিহত ১৬টি শিশু ও শিক্ষ
আত্মঘাতী বন্দুকবাজ |
২৮ এপ্রিল, ১৯৯৬ |
অস্ট্রেলিয়ার এক পর্যটন কেন্দ্র |
নিহত ৩৫ |
এপ্রিল, ১৯৯৯ |
ডেনভারের কলম্বাইন স্কুল |
নিহত ১৩ পড়ুয়া
আত্মঘাতী ২ বন্দুকবাজ |
২৬ এপ্রিল, ২০০২ |
পূর্ব জার্মানির এরফুর্ট |
নিহত ১৬
আত্মঘাতী বন্দুকবাজ |
১৬ এপ্রিল, ২০০৭ |
ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয় |
নিহত ৩২
আত্মঘাতী বন্দুকবাজ |
১১ মার্চ, ২০০৯ |
জার্মানির স্টুটগার্টের এক স্কুল |
হত ১৫, পুলিশের গুলিতে
নিহত বন্দুকবাজ |
২২ জুলাই, ২০১১ |
নরওয়ের ইউটোয়া দ্বীপে সামার-ক্যাম্প |
নিহত ৬৯ ধৃত আততায়ী |
|