কৌতূহল ছিল এক বিধায়ক ও এক সাংসদকে নিয়ে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে কংগ্রেস-তৃণমূল প্রবল টানাপোড়েন চলাকালীন দু’জনেই উদাত্ত কণ্ঠে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ভোটের দিন তৃণমূল শিবিরের সেই দু’জনের এক জন বিধায়ক শিখা মিত্র ভোট দিতে এলেন অনেক পরে। দলের নেতৃস্থানীয় বিধায়কদের ভোট দেওয়া মিটে যাওয়ার পরে। অন্য জন সাংসদ কবীর সুমন এলেনই না! বিধানসভায় ভোট দিতে গেলে পাছে ‘হেনস্থা’র মুখে পড়তে হয়, এই আশঙ্কাতেই অনুপস্থিত রইলেন বলে সুমনের দাবি!
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এ রাজ্য থেকে নির্বাচিত দলের সব সাংসদ বিধানসভাতেই ভোট দেবেন বলে ঠিক হয়েছিল। সেইমতো প্রয়োজনীয় আবেদন এবং নথিপত্রের ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল। সে হিসাবে লোকসভা-রাজ্যসভা মিলিয়ে ২৭ জন তৃণমূল সাংসদের (কে ডি সিংহ বাদে) বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় ভোট দেওয়ার কথা ছিল। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, ২৬ জন ভোট দিয়েছেন। আসেননি যাদবপুরের গায়ক-সাংসদ। তাঁর জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা হয়েছে বিধানসভায়। এমনকী, কংগ্রেস শিবির থেকে
বারংবার ‘বার্তা’ পাঠানো হয়েছে। কারণ প্রণববাবুর পক্ষে ‘ভোট সামলানো’র মূল দায়িত্ব ছিল কংগ্রেসেরই। কিন্তু সুমনের দিক থেকে সাড়া মেলেনি।
পরে সুমন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “শরীরটা ভাল ছিল না। তা ছাড়া, অনেক শুভাকাঙ্খী ফোন করে জানান, আমি গেলে কেউ কটূক্তি করতে পারেন। হেনস্থার চেষ্টা হতে পারে। আমি প্রতিবাদ করতে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।” সুমনের ইঙ্গিত স্পষ্টতই দলীয় সতীর্থদের প্রতি। যা শুনে তৃণমূল নেতৃত্ব যথেষ্ট ‘বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ’। মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বা তৃণমূলের কাউকেই সুমন আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর অনুপস্থিতির কারণ জানাননি। এমনিতেই তৃণমূলের সঙ্গে সুমনের ‘দূরত্ব’ সুবিদিত। কিন্তু প্রণব-প্রশ্নে তাঁর আচরণের কোনও ব্যাখ্যা তৃণমূল শিবির খুঁজে পাচ্ছে না। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “ওঁর সঙ্গেই প্রথম প্রণববাবুর ফোনে কথা হল। উনি ঘোষণা করে দিলেন, প্রণববাবুকে ভোট দেবেনই। দল যখন প্রণববাবুকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিল, তখন নিজে এলেন না! উনি কি যেন তেন প্রকারেণ এটাই দেখাতে চান যে, দল যে দিকে যাবে, তিনি উল্টো দিকে যাবেন?” সুমন আসছেন না দেখে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব তাঁর সঙ্গে এ দিন বারংবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু সুমন ফোন ধরেননি। তাতে কংগ্রেস শিবিরও ‘বিস্মিত’ ও ‘অসন্তুষ্ট’।
ভোট-পর্ব মেটার পর বিধানসভার সচিব তথা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার যাদবলাল চক্রবর্তী জানান, ২৭ জন সাংসদ এখানে ভোট দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। এক জন হাজির হননি। সুমনের আশঙ্কার কথা জানানোয় যাদববাবুর বক্তব্য, “উনি লিখিত ভাবে আমাদের কিছু জানাননি। ভোটদানের কেন্দ্র হিসাবে বিধানসভায় ভোটারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের তরফে আমাদের। উনি নিরাপত্তা চাইলে ব্যবস্থা করা হত।”
তৃণমূলের সাংসদরা এ দিন প্রায় একসঙ্গেই লাইন দিয়ে পরপর ভোট দিয়েছেন। ছিলেন সোমেন মিত্রও। ভোটারদের লাইনে তখন ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা। কিন্তু সোমেনবাবুর বিধায়ক-স্ত্রী শিখাকে তখন বিধানসভায় দেখা যায়নি। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে প্রথমে ‘সৌজন্য’ বিনিময়, পরে অন্য সাংসদদের সঙ্গে বৈঠক সেরে সোমেনবাবু চলে যেতে শিখাকে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বেলা ৩টে নাগাদ বিধানসভায় পৌঁছে ভোট দিতে যান শিখা। মমতা-সহ তৃণমূলের প্রথম সারির নেতৃত্ব তত ক্ষণে চলে গিয়েছেন। সোহরাব-সহ কংগ্রেসের পরিষদীয় নেতৃত্বের সঙ্গেই চৌরঙ্গির তৃণমূল বিধায়কের ‘সৌজন্য’ বিনিময় হয়।
প্রসঙ্গত, তৃণমূলের দুই বিধায়ক ভূষণচন্দ্র দলুই এবং ওমর আলি এ দিন অসুস্থতার জন্য ভোট দিতে আসতে পারেননি। বামফ্রন্টের শরিক আরএসপি-র সাত এবং সিপিআইয়ের দু’জন এবং এসইউসি-র এক বিধায়ক ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই হিসাবে রাজ্যের ২৯৪ জন বিধায়কের মধ্যে ২৮৪ জনের ভোট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই তৃণমূল বিধায়কের অসুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২৮২টি। এঁদের পাশাপাশিই ভোট দিয়েছেন তৃণমূলের ২৬ জন সাংসদ। প্রণববাবুকে সমর্থনকারী বামফ্রন্টের ৫২ জন বিধায়কই উপস্থিত ছিলেন। |