চার দশকের কর্ম ক্ষেত্রেই তৈরি হল তাঁর পরবর্তী উত্তরণের মঞ্চ! তিনি এলেন, ভোট দিলেন। দৃশ্যতই স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়লেন। কিন্তু রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির ভয়ে ঢুকলেন না সেন্ট্রাল হলে। কার্যত নিজের সাংসদ জীবনের শেষ দিনে সরে রইলেন যাবতীয় বিতর্ক থেকে। তবে সেন্ট্রাল হলের মুখে কফি স্টলে এবং সংসদীয় মন্ত্রী পবন বনশলের ঘরে দু’দণ্ড ঘুরে গেলেন যাওয়ার আগে।
আজ সংসদে এমনই ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। একাধারে ভোটপ্রার্থী এবং ভোটদাতা। রাষ্ট্রপতি পদে যাঁর জয় ঘিরে আজ বিন্দুমাত্র সংশয় নেই কংগ্রেসের।
মাঠে-ময়দানের জননেতা কখনওই ছিলেন না প্রণববাবু। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রায় সবটা জুড়েই রয়েছে রাজ্যসভা ও লোকসভা। ১৯৯৭ সালে সেরা সাংসদের সম্মান পেয়েছেন বলেই নয়। গত দশ বছরে তো বটেই, তার আগেও কি বিরোধী কি শাসক দল, যখন যেখানেই থেকেছেন, সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁকেই নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে। আর মাত্র তিন দিনের মধ্যেই এই কর্ম ক্ষেত্র পুরোপুরি তাঁর পূর্বাশ্রমে পরিণত হবে। আজ সেই সংসদেই গোটা দিন ধরে চলল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
তৈরি হল তাঁর উত্তরণের ক্ষেত্র। সেখানে তাঁর নিজেরও অবদান রইল। নিজের সাংসদ জীবনের অবসান ঘটাতে ভোট দিলেন সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায়। বললেন, “এর পর বছরে এক বারই সংসদে যাব, বাজেট অধিবেশনে যৌথ সভায় ভাষণ দিতে।”
ফল বেরোবে ২২ জুলাই। কিন্তু আজ থেকেই কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী যেন আগাম সৌজন্য দেখাতে শুরু করেছেন প্রণববাবুকে। সকাল ১১টা নাগাদ তিনি সংসদ ভবনে পৌঁছন। লিফটে দোতলায় ওঠার সময় প্রণববাবু সনিয়াকে অনুরোধ করেন আগে উঠতে। কিন্তু কংগ্রেস সভানেত্রী সসম্মানে প্রণববাবুকেই এগিয়ে দেন। তার পর ওঠেন প্রধানমন্ত্রী। সব শেষে সনিয়া নিজে। একটু পরেই তিন জন পৌঁছন দোতলার ৬৭ নম্বর ঘরে। ভোট দিয়ে প্রণব বেরিয়ে গাড়িতে প্রায় উঠে পড়েছেন। হঠাৎই ছুটতে ছুটতে আসেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের পুত্র কংগ্রেস সাংসদ সন্দীপ দীক্ষিত। বলেন, “এক বার চলুন শেষ বারের মতো সেন্ট্রাল হলে গিয়ে বসি। অনেকেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
এটা ঘটনা যে, গত দশ বছরে সেন্ট্রাল হলে গিয়ে কখনওই আড্ডায় বসতেন না প্রণববাবু। যাঁর সঙ্গে কথা বলার দরকার হত, ডেকে নিতেন নিজের ঘরে। কিন্তু মন্ত্রিপদে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকে তিনি সংসদে ঘরশূন্য! আজ তাই সেন্ট্রাল হল ছাড়া গতি নেই। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও আজ সেখানে গিয়ে বসলেন না প্রণববাবু। গত কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জেনেছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও কী ভাবে রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধে পরিণত হয়। তাই কিছু ক্ষণের জন্য সেন্ট্রাল হলের দরজার কাছে দাঁড়িয়েই খোশমেজাজে গল্প করলেন। কিছু ক্ষণ বসলেন পবন বনশলের ঘরে। পরে বললেন, “সেন্ট্রাল হলে গেলাম না। কারণ তা হলে বিরোধীরা এটাকে ইস্যু করে বলতে পারত, আজও প্রচার করছি।”
সংসদে আজকের নির্বাচনী যুদ্ধ কার্যত মিটে গিয়েছিল প্রথম দু’ঘণ্টায়। দুপুর বারোটার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়ে যায়। ইউপিএ-র প্রার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় ভোট যাতে একটাও বাইরে না যায়, সে জন্য গোড়া থেকে সব চেয়ে তৎপর ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। বাইরের অলিন্দ থেকে ভোটদান কক্ষ পর্যন্ত শরিক সাংসদদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার কাজটি বেশির ভাগ সময়ে তিনিই করেছেন। যদিও আত্মবিশ্বাসে কোনও ঘাটতি ছিল না কংগ্রেস শিবিরে। নারায়ণস্বামী, পবন বনশলরা তো দুপুর থেকেই বলতে শুরু করেছেন, বিরাট ব্যবধানে তাঁদের প্রার্থী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিততে চলেছেন। ‘প্রার্থী’ কিন্তু সংসদের ‘মায়া’ কাটিয়ে বাড়ি ফিরেই বসে গেলেন ভোটের চুলচেরা হিসাবে। তাঁর টেবিলে এখন ফাইলের স্তূপ নেই ঠিকই। কিন্তু সেই জায়গা নিয়েছে দেশের ‘নির্বাচনী মানচিত্র’। ঘন ঘন ফোন যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে অরুণাচল। পোলিং এজেন্টদের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি, “সব ভোট পড়ে গেলেও ব্যালট বাক্স ছেড়ে যাবেন না। সিল না করা পর্যন্ত বসে চা খান। গল্প করুন।”
তবে ফলাফল না বেরোনো পর্যন্ত এই ‘হিসাব’ কষলেও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন প্রণববাবু। ফল বেরোনোর পরে ২৪ তারিখ রাতে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল তাঁর সম্মানে ভোজ দেবেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। ২৫ তারিখ সংসদে শপথ নিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় সোজা চলে যাবেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। শুরু হবে তাঁর নতুন জীবন।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন পড়ে রয়েছে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র জঙ্গিপুরে। “ওঁদের তো ধন্যবাদ জানানো হল না,” খেদোক্তি প্রণবের। কবে এবং কী ভাবে যাবেন জঙ্গিপুরে? বললেন, “২২ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে সময় আছে ঠিকই। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট হয়ে যাওয়ার পর কোনও রাজ্যে গেলে সেখানে বিশাল প্রোটোকল ও নিরাপত্তার প্রশ্ন এসে যায়। এত অল্প সময়ে রাজ্য সেই আয়োজন করে উঠতে পারবে না।” |