সনিয়া গাঁধী গত কালই বলেছিলেন, রাহুল এ বার সিদ্ধান্ত নিক। তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রাহুল ঘোষণা করলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। দল এবং সরকারে আরও বড় দায়িত্ব নিতে, আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে তিনি তৈরি। কী দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে এবং কবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অবশ্য তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন দলীয় নেতৃত্বের উপরেই।
ঠিক যেন রাজনৈতিক চিত্রনাট্য। তা মেনেই রাহুল গাঁধীর অভিষেকের প্রস্তুতি এগোচ্ছে। কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা অনেক আগে থেকেই দাবি তুলতে শুরু করেছিলেন। সম্প্রতি সেই দাবি আরও জোরালো হয়েছে। কংগ্রেসের নেতাদের এই দাবিতে সাড়া দিয়ে গত কাল সনিয়া ছেলের উপরে কিছুটা যেন চাপই তৈরি করেছিলেন। আর তার পরেই আজ সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতে এসে রাহুল বললেন, “আমি দল ও সরকারে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নেব। সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন কংগ্রেস নেতৃত্ব সময়ের বিষয়টা ঠিক করবেন।”
সনিয়ার পরে রাহুলই যে দলে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। রাহুলের আজকের এই সিদ্ধান্তে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই বলেই জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা জনার্দন দ্বিবেদী। তাঁর বক্তব্য, “রাহুলের এই মন্তব্যকে কংগ্রেস সভানেত্রীর মন্তব্যের পরিপূরক হিসেবেই দেখতে হবে।” রাহুলের আজকের ঘোষণায় সব থেকে খুশি অবশ্যই দিগ্বিজয় সিংহ। কারণ ‘রাহুল লাও’ দাবি তোলার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় পুরোধার ভূমিকা নিয়েছিলেন। আজ তাঁর মন্তব্য, “আমি দু’বছর ধরে এই কথাটা বলে আসছি। গোটা দেশেই রাহুলকে বড় দায়িত্ব দেওয়া উচিত।” কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায় শপথ নেবেন ২৫ জুলাই। তার পরে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু ৮ অগস্ট। এর মাঝের সময়টাই সরকার ও দলে রদবদলের পক্ষে আদর্শ। |
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন রাহুল গাঁধী। নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই |
দিল্লির রাজনীতির কারবারিদের অনেকের মতে, এ বার সম্ভবত সরকারেই যোগ দিতে চলেছেন রাহুল। প্রধানমন্ত্রী অনেক বারই বলেছেন, তাঁর মন্ত্রিসভার দরজা রাহুলের জন্য সব সময়ই খোলা। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের মেয়াদ এখনও দু’বছর। মন্ত্রিসভায় এলে এই সময়ের মধ্যে রাহুলের পক্ষে কাজ করে দেখানো সম্ভব বলেই মনে করছেন কংগ্রেসের অনেক নেতাই।
সরকারে এলে কোন পদে আসবেন রাহুল? দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীদের একটা অংশের মতে, তাঁকে স্বরাষ্ট্র, অর্থ, প্রতিরক্ষা বা বিদেশ এই চারটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের একটিতে বসানো হোক। অন্য অংশের যুক্তি, রাহুলকে মানবসম্পদ উন্নয়ন বা গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব দিলে আমজনতার জন্য ‘কাজ করে দেখানো’-র সুযোগ অনেক বেশি পাবেন। তাঁদের মতে, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জমানায় এ ভাবেই তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রী হিসেবে হাতেখড়ি হয় ইন্দিরা গাঁধীর।
তবে দল বা সরকারে রাহুলের বৃহত্তর অভিষেক যে নিষ্কণ্টক হবে না, সেই ইঙ্গিত দিয়ে আজ তাঁর সিদ্ধান্তকে ‘স্বাগত’ জানিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেসের মধ্যে ‘পরিবারতন্ত্র’ ও ‘গণতন্ত্রের অভাব’ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ পেয়েছে তারা। রাহুলের বড় দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘দেশের প্রতি রসিকতা’ বলে কটাক্ষ করার পাশাপাশি দলের মুখপাত্র নির্মলা সীতারামণের বক্তব্য, “কে কোন দায়িত্বে যাচ্ছেন, তাতে কিছুই এসে যায় না। সবটাই পারিবারিক বিষয়!” রাহুল সরকার বা দলে ‘দায়িত্বপূর্ণ’ পদে এলে তাঁকে সরাসরি আক্রমণের সুযোগ মিলবে বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলের নেতা বলবীর পুঞ্জের বক্তব্য, “এত দিন কোনও দায় না নিয়ে রাহুল সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। এ বার তাঁকে দায়ও নিতে হবে।” অর্থাৎ, মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে মূল্যবৃদ্ধি থেকে দুর্নীতির অভিযোগ সব কিছুর জন্যই যে রাহুলকে দায়ী করতে কসুর করা হবে না, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
বিরোধীদের এই নিশানাই রাহুলকে সংগঠনের গুরুদায়িত্বে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কংগ্রেস নেতৃত্বের আশঙ্কার কারণ ছিল। তাই ‘তুরুপের তাস’ হিসেবে তাঁকে আড়াল করা হচ্ছিল। সে সঙ্গে প্রথমেই যাতে রাহুলের মাথায় ব্যর্থতার দায় চেপে না বসে, তা নিয়েও সতর্ক ছিলেন এআইসিসি নেতারা। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। কিন্তু দুই রাজ্যেই তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ব্যর্থতার দায় রাহুল নিজের কাঁধে নিলেও কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, রাজনীতিতে হারজিত থাকবেই। সরকারে এলে রাহুলের সমালোচনার সম্ভাবনা নিয়ে দিগ্বিজয়দের বক্তব্য, কোনও সরকারই দশ বছর ক্ষমতায় থাকলে শেষ দু’বছরে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিই নেতা হিসেবে উঠে আসার আদর্শ সময়। |