শিল্পাঞ্চল অনেক আগে থেকেই ‘স্বাতন্ত্র্য’ চাইছিল। তারই প্রথম সবুজ সঙ্কেত এসেছে। স্বাভাবিক ভাবেই খুশি আসানসোল-দুর্গাপুরের সিংহভাগ বাসিন্দা। খুশি প্রশাসনের কর্তারাও। তবে সিপিএমের বিশেষ আগ্রহ নেই।
অশোক মিত্র কমিশন বহু আগেই জেলা ভাগের সুপারিশ করেছিল। বামফ্রন্ট সরকার কয়েকটি ক্ষেত্রে তা কার্যকরও করে। কিন্তু ‘লালদুর্গ’ বর্ধমান ভাগাভাগির পথে যায়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, একে শিল্পাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অনেক কম। তার উপরে পশ্চিমাংশে হিন্দি ভাষাভাষীদের সংখ্যা এতই বেশি যে ভাগাভাগিতে সায় দিলে ভবিষ্যতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের দাবিও উঠতে পারে। বৃহস্পতিবারও দুর্গাপুরের প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য রথীন রায় দাবি করেন, “জেলা ভাগ হলে দুর্গাপুরের খুব একটা লাভ হবে না।”
তবে সাধারণ মানুষ থেকে বণিকমহলের মত ভিন্ন। এখনও দুর্গাপুর ও আসানাসোল থেকে বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রয়োজনে বর্ধমানে দৌড়তে হয় তাঁদের। ঝাড়খন্ড সীমানা লাগোয়া রূপনারায়ণপুর বা চিত্তরঞ্জনের বাসিন্দাদের জন্য সেই দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। সেখানে আসানসোলে সদর কার্যালয় হলে দূরত্বটা এক ধাক্কায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে। শিল্পাঞ্চলের রাজস্ব আদায় বেশি হলেও পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ তেমন হয় না বলেও খেদ রয়েছে অনেকের। ফেডারেশন অফ সাউথ বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সম্পাদক রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতানের আশা, “এ বার আমরা এই বৈষম্য থেকে মুক্তি পাব।” আসানসোলের চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি সুব্রত দত্তের মতে, “পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলে সরকারি ও বেসরকারি লগ্নি আসবে। ব্যবসার অন্যান্য দিক খুলবে।”
একাধিক রাষ্ট্রীয় শিল্পসংস্থার আধিকারিকদের প্রায়ই জেলাশাসক পর্যায়ে বৈঠক করতে হয়। এর জন্য বর্ধমানে ছুটতে হয়। হাতের সামনে জেলাসদর কার্যালয় থাকলে সময়ও বাঁচে, হয়রানিও কম হয়। বার্নপুরের ইস্কো স্টিল প্ল্যান্টের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ভাস্কর কুমারের মতে, “জেলা ছোট হলে কাজের অনেক সুবিধা হবে। আমরা সহজে জেলাশাসক পর্যায়ে আলোচনার সুযোগ পাব।” ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায়ও বলেন, “সুদূর বর্ধমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কঠিন হয় মাঝে-মধ্যে। জেলা ভাগে শিল্পাঞ্চলও অনেক উপকৃত হবে।” জেলাসদর তৈরি হলে সব রকমের সরকারি দফতরও হবে। চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত বলেন, “আমাদের বিভিন্ন কাজে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করতে এখন বর্ধমানে যেতে হয়। ভবিষ্যতে আশা করি তা আসানসোলেই হয়ে যাবে।” চিকিৎসকদের যুক্তি, আসানসোল, দুর্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার চিকিৎসা পরিষেবার আরও উন্নতি দরকার। আসানসোলে জেলা হলে সেই সুযোগ বাড়বে।
শিল্পপতি সুধাময় ঘাঁটির মতে, নতুন জেলা হওয়া মানেই উন্নতির পথে কয়েক ধাপ এগোনো। এর পরে সরকারি অনুদান বাড়বে। তা কাজে লাগিয়ে এই শিল্পাঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তবে নতুন জেলা এবং কিছু সরকারি দফতরের সম্প্রসারণই এক মাত্র চাহিদা নয় শিল্পাঞ্চলবাসীর। শিল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগও চাইছেন তাঁরা। মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অনামিকা চৌধুরী বলেন, “এ বার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও হোক। উচ্চশিক্ষার আরও দরজা খুলুক।” প্রাক্তন সরকারি কর্মী গিরিজাশঙ্কর দত্তের আশা, “এত দিন বর্ধমানে গিয়ে যে সুবিধা আদায় করা যেত, এ বার সেই সুবিধা হাতের কাছেই পাব।”
ভাগাভাগির ক্ষেত্রে অবশ্য মতান্তর রয়েছে সীমানার কাঁকসা ব্লক নিয়ে। এই ব্লকের তিনটি পঞ্চায়েত গোপালপুর, মলানদিঘি ও আমলাজোড়া দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভা এলাকায়। আবার কাঁকসা, বিদবিহার, ত্রিলোকচন্দ্রপুর ও বনকাটি পঞ্চায়েত পড়ে গলসি বিধানসভা এলাকায়। ওই ব্লক ভাগ করা নিয়ে সিপিএম ও কংগ্রেসের আপত্তি রয়েছে। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, একাধিক বার সর্বদল বৈঠক করে রাজ্যস্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কাঁকসা ব্লককে আপাতত আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের বাইরে রাখা হয়েছে। নতুন জেলা হলে শুধু এই অংশটুকুকে কমিশনারেটের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে, প্রস্তাবিত পুরো নতুন জেলাই চলে যাবে কমিশনারেটের আওতায়। তখন প্রয়োজনে রাজ্য সরকারকে নতুন আইন আনতে হতে পারে। নতুন জেলা হলে দুর্গাপুর মহকুমা থেকে গলসি ১ চলে যাবে বর্ধমান সদরে। গলসি ও বুদবুদ চরিত্রগত ভাবেই গ্রামীণ এলাকা। সেখান থেকে বর্ধমানের দূরত্বও আসানসোলের থেকে কম। ফলে গলসি ১ ও ২ ব্লক সাবেক বর্ধমানে থাকলে আপত্তির কিছু দেখছে না কোনও মহলই। |