মাথা থেকে হাত দশেক দূরেই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎবাহী তার। সেই তার ছুঁলে আর দেখতে হবে না। প্রায় দেড়শো ফুট নীচে শক্ত মাটি। সেখানে আছড়ে পড়লে কী হবে, তা ভাবতেই অনেকে আৎকে উঠছিলেন।
যাঁকে নিয়ে দুর্ভাবনা, তার অবশ্য হুঁশ নেই। হাইটেনশন বিদ্যুৎতের খুঁটির উপর বসে তিনি দিব্যি পা নাচাচ্ছিলেন। আর তাঁকে নীচে নামিয়ে আনার জন্য সাধ্য-সাধনা করছেন পুলিশ-দমকল-বিদ্যুৎকর্তা থেকে আম জনতা।
বুধবার মানবাজারের মহড়া হাইস্কুলের পাশে বিদ্যুৎতের খুঁটিতে উঠে পড়া ওই যুবককে উদ্ধার করা নিয়ে রুদ্ধশাস নাটক হয়ে গেল। এ দিন সকাল প্রায় ৮টায় স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে তরতরিয়ে খুঁটি বেয়ে উপরে উঠে যেতে দেখেন। প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্মী বুঝি মেরামতি করতে উপরে উঠছেন। মহড়া গ্রামের বাসিন্দা রিন্টু রায়, অমূল্য মণ্ডল, পবিত্র মাহাতোরা বলেন, “ঘণ্টাখানেক পরেও তাঁকে নীচে নামতে না দেখে সন্দেহ হয়। পুলিশে খবর দেওয়া হয়।” |
গ্রামের বধূ রিনা রায়, টুসু মাহাতো বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম বাড়িতে রাগ করে কিছু একটা কাণ্ড বাধাতে এসেছে। বাড়ি থেকে থালায় ভাত এনে ওঁকে নীচে নেমে চাট্টি খেতে ডাকি। কিন্তু নামলই না।”
খবর পেয়ে পুলিশ আসে। আসে দমকলের লোকজনও। খবর দেওয়া হয় ন্যাশানাল পাওয়ার গ্রিডের লোকেদেরও। এলাকার বাসিন্দারাও ভিড় করেন। স্কুল পালিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরাও সেই জটলায় ভিড় করে। একে তো নীচ থেকে চিৎকার করে হাঁকডাক করেও উপরের যুবকটির কোনও সাড়া মিলছে না। তার উপর ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। সব সামলাতে হিমশিম পুলিশ কর্মীরা। এক পুলিশ আধিকারিক স্কুলের এক শিক্ষককে ডেকে বললেন, “আপনাদের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যান। এখানে ওরা বড্ড গোল করছে।” তত ক্ষণে কিছু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মানবাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরাও হাজির। সবারই আশঙ্কা, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। একে বারে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি!
পাওয়ার গ্রিডের ইনচার্জ (বাঁকুড়া) আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “৪৪০ কেভির এই বিদ্যুতের লাইন জামশেদপুর থেকে অন্ডাল গিয়েছে। বিদ্যু সংযোগ ছিন্ন করে ওই যুবককে নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।” পরে বিদ্যুৎতের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই যুবককে নামানোর জন্য উপরে ওঠার ঝুঁকি নেওয়া যাচ্ছিল না। মানবাজার থানার ওসি দিবাকর লাহিড়ি বলেন, “উদ্ধার করতে কেউ উপরে উঠলে ওই যুবক যদি ঝাঁপ দেন, তাহলে সব চেষ্টাই বৃথা হয়ে যাবে। তাই উপরে লোক পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না।”
মনসারাম মণ্ডল।
|
শেষে মানবাজার ব্লক অফিসের বিপর্যয় মোকাবিলা দলকে খবর দেওয়া হল। কিন্তু ওঁরা আসার আগেই দুপুর সাড়ে ৩টেয় খুঁটির নীচে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন স্থানীয় কপড়রা গ্রামের ভঁদুলাল টুডু। তিনি এসে বলেন, “আরে ও তো দাদার শ্যালক মনসারাম হেমব্রম। আমাদের বাড়িতে সোমবার বেড়াতে এসেছিল। সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খোঁজ করতে এসে দেখি এই কাণ্ড।” এরপর তিনি মনসার নাম ধরে কয়েকবার হাঁক দেন। সবাইকে অবাক করে মনসা ফের তরতরিয়ে নেমে এলেন। এসেই বললেন, “জল খাবো। খুব তেষ্টা পেয়েছে।”
শুকনো মুখ। সবারই তাঁকে প্রশ্ন, কেন উঠেছিলেন উপরে? কারও উপর অভিমানে? জবাব নেই তাঁর মুখে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মানবাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এ দিনটা তাঁকে সেখানেই চিকিৎসকেরা পর্যবেক্ষণে রাখেন। ভঁদুলালবাবুর ছেলে সন্তোষ বলেন, “বরাবাজার থানার মহুলবনায় মনসারামের বাড়ি। গ্র্যাজুয়েট ছেলে চাষবাস করে। বেশ সুস্থসবল। কেন যে এমন করল আমরাও বুঝতে পারছি না।” |