|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ওদের ‘আপন’ করবেন না, মানুষের সম্মান দিন |
রত্নাবলী রায় |
মানসিক ভারসাম্যহীন গুড়িয়া একটি হোমে মারা গেলেন। শুরু হল দোষারোপের পালা। ধর্ষণকারী, হোমের সুপার, প্রতিষ্ঠাতা, ব্লক অফিসার, সমাজ কল্যাণ আধিকারিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাউকে যেন ছেড়ে কথা বলা না হয়, তার দায়িত্ব নিয়ে নিল গোটা সমাজ।
ধরুন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অপরাধীরা ধরা পড়ল, তাদের শাস্তিও হল। পরবর্তী হোমের পরবর্তী গুড়িয়া কি তাতে বাঁচবে? তা কিন্তু বাঁচবে না। তা হলে কি সেই মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে আরও এক বার অপরাধীর শাস্তি চাইবার জন্য গলা ফাটাব? এবং তার পর আরও এক বার?
অপরাধীর শাস্তি অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন অপরাধ রোধ করা। অপরাধের কারখানায় কাজ করে কেউ নিরপরাধ থাকতে পারে না, অপরাধের কারখানায় বাস করে কেউ অপরাধের শিকার না হয়ে থাকতে পারে না। আমাদের সরকারি বা বেসরকারি ‘হোম’, বা মানসিক রোগীদের হাসপাতাল, এগুলির গঠন-চরিত্র-হৃদয়বৃত্তি এমনই যে এখানে যাঁরা আসবেন, থাকবেন, তাঁরা সকলেই কমবেশি ‘গুড়িয়া’তে পরিণত হবেন।
সতেরো বছর মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগে উপলব্ধি হয়েছে যে, আমাদের ‘হোম’ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মূল মানসিকতা হল ‘কাস্টডিয়াল’ বা তত্ত্বাবধায়কের। ধরেই নেওয়া হয় বাসিন্দারা অবমানব, বোধবুদ্ধিহীন, অপ্রাপ্তমনস্ক, নিজের ভাল বোঝেন না। কর্মকর্তারা আবাসিকদের ‘ভাল’ বুঝে নিয়ম বানাবেন। আর মাঝের লোকেরা সেই নিয়ম প্রয়োগ করবেন। নিয়ম তৈরির ‘মহাযোগ্যতা’ যাঁদের আছে তাঁরা কী চাইছেন, কেন চাইছেন, কতটা চাইছেন, কেউ জানবে না। আবাসিকরাও তা জানার অধিকারী নয়, কারণ প্রতিষ্ঠানের চোখে তাঁরা অজ্ঞান, মূর্খ, অবুঝ। ‘অ্যাডাল্টিজম’ এই ভাবে শাসন-অত্যাচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কখনও সত্যিই বয়সে ছোট বলে, কখনও মানসিক ভারসাম্য না থাকার কারণে, কখনও মেয়ে, গরিব, ছোট জাত হওয়ার জন্য, এক জন রোগী কখনও পূর্ণ মানুষের সম্মান পান না। |
|
প্রান্তিক? অপর্ণা সেনের ‘ফিফটিন পার্ক অ্যাভিনিউ’ ছবির একটি দৃশ্য। |
এর পর আছে ‘মায়ার খেলা’। বাইরে থেকে যদি কেউ জানতে চান যে ভেতরের মানুষরা কেমন আছে, বা জেনে ফেলেন যে তারা ভাল নেই, অমনি প্রতিষ্ঠান চেঁচিয়ে বলে ‘আমরাই তো ওদের দেখি, আমরাই যত্ন করে ভাত মেখে মুখে তুলে দিই। সেই সঙ্গে যদি কিছু বকুনি, মারধর হয়, তা হলে এমন কী বা ক্ষতি হল! যা করছি তা তো ভালবেসেই করছি।’ এ হল ‘স্নেহমায়া’। আর ‘মহামায়া’ বা ভ্রান্তি হল, ‘আপনি কী জানেন মশাই? ওরা এর থেকেও খারাপ জায়গায় থাকত, এর থেকেও খারাপ খাবার খেত, এর থেকেও নোংরা হয়ে থাকত, এখানে তো ভালই আছে সেই তুলনায়।’ কিংবা, ‘পালিয়ে যায় তাই বেঁধে রাখতে হয়, কাপড় পরাতে দেয় না তাই উলঙ্গ রাখতে হয়, আমরা কত কষ্ট করি তবু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না...’ অর্থাৎ, যে মুহূর্তে সামাজিক ন্যায় বা অন্যায়ের কথা ওঠে, তখনই এসে পড়ে মায়া, ভালবাসা, ‘আপন’ ভাবা, এই সব।
প্রতিষ্ঠান চলে কর্মীদের সুবিধের জন্য। মাঝের তলার মানুষদের সুবিধা হবে বলে আবাসিকদের সুস্থ থাকার সামান্য সুযোগসুবিধা দেওয়া হয় না। অর্থের অভাবও সুবিধের সীমা তৈরির কাজটিতে বেশ সাহায্য করে। সরকার যদি মাথাপিছু দিনে ১৭ টাকা বরাদ্দ করেন, তা হলে সেই ১৭ টাকা বা তার কমে দিন চালাবার নিয়ম করা হয়, যা কার্যত অসম্ভব। ফলে, অনাহার, অপুষ্টি, অপরিচ্ছন্নতা থাকতে বাধ্য। তবু প্রতিষ্ঠান চলে, কারণ রাষ্ট্র তা তুলে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারে না।
তবে কি প্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়াই ভাল? কখনওই নয়। কিন্তু ভাবা দরকার, যে প্রতিষ্ঠান বাস্তবিক মানসিক রোগীদের জন্য কাজ করবে, কেমন হবে তার আয়তন, গঠন, কাজের পদ্ধতি? কী যোগ্যতা থাকবে তার কর্মীদের? প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের উপরই নির্ভর করে আবাসিকের রোগের উপশম ঘটবে, সে আরাম, প্রশান্তি পাবে, না কি আরও বিপন্ন, বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, এমনকী নির্যাতনে তার মৃত্যুও ঘটে যাবে নীরবে।
কেমন হবে সংশোধিত প্রতিষ্ঠান? প্রথমত, ক্ষমতার অসমবণ্টন যথাসাধ্য কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিষ্ঠান চলবে নানা ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। নীতি নির্ধারণ হবে আবাসিক এবং কর্মীদের একত্র সিদ্ধান্তে। সব রোগী যে সমান ভাবে মতামত জানাতে পারবেন, তা হয়তো নয়। কিন্তু মূল কথা হল, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজটি কয়েকটি কর্তার অভিভাবকত্বের ভিত্তিতে হবে না, হবে রোগীর অধিকারের ভিত্তিতে। রোগীদের যে কেউ দয়া করে আশ্রয় দেয়নি, ডাক্তার-আধিকারিকদের মতো রোগীও যে এক যৌথ কর্মকাণ্ডের সহযোগী ও অংশীদার, সেই কথা প্রতিষ্ঠানের মজ্জায় প্রবেশ না করলে তার কাজে প্রকাশ পাবে না।
প্রতিষ্ঠানকে হতে হবে ছোট। একশো-দেড়শো বেডের নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠানের জায়গায় পনেরো-কুড়ি জনের থাকার মতো ছোট, বিশেষ প্রয়োজননির্ভর প্রতিষ্ঠান চাই। বড় প্রতিষ্ঠানে মানবাধিকার ভঙ্গের ঝুঁকি বেশি থাকবেই। কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ চাই, কারণ মানসিক পরিচর্যা বিষয়ে তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ত বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে রোগীদের সঙ্গে কথা বলার, তাঁরা কেমন আছেন সে বিষয়ে উচ্চমানের তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা তৈরি করতে হবে। ভুলে গেলে চলে না, মনোরোগীদের সঙ্গে কাজ করা মানে কেবল সহানুভূতি, ভালবাসা দেওয়া নয়, উচ্চমানের শুশ্রূষার দক্ষতা তৈরি করা।
যে প্রতিষ্ঠানে এই সব পরিবর্তন হবে, সেখানে রোগীকে কেউ ‘তুই’ সম্বোধন করে অবমানবে পরিণত করবে না। তেমন প্রতিষ্ঠানে আবাসিকদের ডায়ারিয়া হচ্ছে জেনেও দিনের পর দিন শাকভাত খাওয়ানো হবে না। জলের অভাবে রোগীদের গায়ে ঘা-পাঁচড়া হয়ে যাবে না, তেল-সাবান জোগানোর চাইতে রোগিণীদের চুল ছেঁটে দেওয়া সহজ মনে হবে না। সেখানে মুখ দেখার জন্য মেয়েদের একটা করে আয়না থাকবে। পায়ে চটি থাকবে। কলবুক দিলে ডাক্তারবাবু পাওয়া যাবে দশটা-পাঁচটার পরেও। সেখানে রোগীদের মনে আগ্রহ-সঞ্চারের জন্য সরকারি কর্তারা রাংতার প্যাকেট ছিঁড়ে ওষুধ বার করার চাইতে আর একটু ভাল কোনও কাজ ভাবতে পারবেন।
এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি না হলে নীরবে ধর্ষণ, মৃত্যু, চোরাকবর ঘটতেই থাকবে। মানুষের মতো বেঁচে না থাকলে মানুষের মতো মৃত্যুও সম্ভব নয়। |
|
|
|
|
|