প্রবন্ধ ৩...
আরও কত গুড়িয়া
হুগলির খেজুরদহের ‘দুলাল স্মৃতি সংসদ’-এর হোমে গত ২৬ জুন রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছে বত্রিশ বছর বয়সী গুড়িয়ার। পুলিশের প্রাথমিক প্রতিবেদনে তার দেহে ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, যৌন অত্যাচারের পর সম্ভবত খুন করা হয়েছে গুড়িয়াকে, বা ধর্ষণ প্রতিহত করার কারণে মার খেতে খেতে মৃত্যু হয়েছে ওর। কিন্তু গুড়িয়া কি একাই এ অবিচারের শিকার?
আসলে সমস্যা অনেক গভীরে। হোমে, পথে, পরিবারে, বিনোদনের ক্ষেত্রে, হাসপাতালে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র গুড়িয়ারা ব্রাত্য। ‘গুড়িয়ারা’ মানে মেয়েরা এবং মানসিক অসুস্থ মেয়েরা। প্রথমত মেয়ে বলে, দ্বিতীয়ত ‘পাগল’ বলে এরা দ্বিমাত্রিক বঞ্চনা এবং অত্যাচারের শিকার। সত্যি বলতে, যে মেয়েদের গায়ে তথাকথিত মানসিক রোগীর তকমা থাকে না, তারাও সমাজ-নির্দিষ্ট আচরণবিধির বাইরে পা ফেললে পরিবারে এবং সমাজে ‘পাগল’ ও এলেবেলে হিসেবে গণ্য হন। তাদের কার্যকলাপ নিয়ে হাসিঠাট্টা চলে, তির্যক মন্তব্য, কখনও সখনও বকুনি পর্যন্ত জোটে কপালে! এই বিধিভঙ্গের সীমাও নির্ধারিত হয় সমাজের ফরমানে। মেয়ের পারিপার্শ্বিক যদি মনে করে মেয়ের ব্যবহার সমাজের তৈরি ‘কোড অব কন্ডাক্ট’-এর সীমারেখা লঙ্ঘন করছে, তা হলে তার ‘অন্য রকম’ আচরণ তাকে নিছক মেয়ে থেকে করে তোলে ‘ছিটগ্রস্ত’ মেয়ে। এই সীমা ছাড়ানোর মাত্রা অনুযায়ী সে মেয়ের জন্য দাওয়াই ঠিক হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মারধর অথবা যৌন অত্যাচার। আসলে, আমাদের আবহে মেয়ে এবং ‘পাগল’ মেয়ের মধ্যে যথার্থ ব্যবধানটা মাত্র কয়েক সুতোর।

আমরা কাজ করি কলকাতার লাগোয়া গ্রামে। সেখানে প্রচলিত লব্জ হল ‘ব্রেন শর্ট’। সেখানে মেয়েরা আজও একটু জোরে হেসে গড়িয়ে পড়লে তাকে বলা হয় ‘ব্রেন শর্ট’। আবার সত্যিকার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন যার, তাকেও ওই ‘ব্রেন শর্ট’ বলে খেতে দেওয়া হয় না, ফেলে রাখা হয় বিনা চিকিৎসায়। মানসিক রোগের দাতব্য কাউন্সেলিং সেন্টার চালালেও প্রভূত কলঙ্কের ভয়ে সেখানে মেয়েরা পৌঁছতে পারেন না। আদপে এ অসুখে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তাই স্বীকার করা হয় না সে অঞ্চলে। সাম্প্রতিক কালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। রুমা (নাম পরিবর্তিত) এই অঞ্চলেরই আমালি গ্রামের মেয়ে। বিয়ে হয় ষোল বছরে। বছর না ঘুরতেই বাপের বাড়ি চলে আসেন রুমা। রুমার মা ওকে আবার অন্যত্র বিয়ে দেন যখন ওর বয়স উনিশ। সেখানেও রুমা টিকতে পারেন না। বারে বারে মায়ের কাছে চলে আসেন আর তার মা প্রতিবারই তাকে শ্বশুরবাড়ি ফেরত দিয়ে আসেন। শ্বশুরবাড়িতে বেধড়ক মার খান রুমা। ওর কথাবার্তা, চলনবলন সবই অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। রুমার মা এবং স্বামী দু’জনেই জানেন রুমার ‘ব্রেন শর্ট’। তথাপি রুমা মার খান আর পালিয়ে বেড়ান।
শহরাঞ্চলেও ছবিটা প্রায় এক, উনিশ-বিশ ফারাক। মনে পড়ে শৈলী ‘পাগলি’কে। উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়ির বউ ছিলেন তিনি। বেশ কিছু দিন ঘরসংসার করে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর হঠাৎ মানসিক বিকার দেখা দিল। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইতেন। পরিবারের লোকও একদিন চলে যেতে দিল। ওঁর স্বামী আবার বিয়ে করলেন, সন্তানেরা ওঁকে মা বলে চিনত না পর্যন্ত। স্কুল যাওয়া-আসার পথে রোজ শৈলীকে দেখতাম, গলির রকে বসে আপন মনে বকে চলেছেন। ওর নামে পাড়াসুদ্ধ লোক বাচ্চাদের ভয় দেখাতেন। অথচ কী নিরীহই না ছিলেন তিনি!
অতএব, মাথা খারাপ নারী এ সমাজে সদাই বাড়তি। গুড়িয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্নও নয়, ব্যতিক্রমও নয়। মানসিক রোগিণীদের পথঘাট থেকে উদ্ধার করে কোনও একটা হোমে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। খোঁজও করে না সে হোমের লাইসেন্স আছে কি না, ব্যবস্থাপনা কেমন, সুরক্ষা কতখানি! সে সব হোম কর্তৃপক্ষও এই মেয়েদের মনে করে ‘বেওয়ারিশ’ মেয়ে। অতএব, তাকে দিয়ে যৌনকার্য থেকে হোমের সকলের জন্য বিনা পয়সায় রন্ধনকার্য পর্যন্ত সবই করানো চলে। দিনান্তে আধপেটা ভাতের আশায়, রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশায়, ফুটপাথে ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণের আশায় আবাসিকরা সব কিছু সহ্য করেন। আর সহ্য যদি না করেন, তবে তার পরিণতি হয় গুড়িয়ার মতো। আবহমান কালের এ দস্তুর একবিংশতেও বহাল! ধন্য আমাদের প্রগতি, ধন্য উন্নয়ন।
এ প্রসঙ্গে, এক দশক আগে ঘটে যাওয়া তামিলনাড়ুর এরওয়াদি হোমের ঘটনা স্মর্তব্য। ২০০১-এর ৬ অগস্ট এরওয়াদি হোমে আগুন লাগে। ২৫ জন মানসিক রোগিণী সে আগুনে পুড়ে মারা যান। কারণ, তাঁরা ছিলেন শিকলবন্দি। আগুন থেকে পালানোর উপায় ছিল না তাঁদের। আর তাঁদের উদ্ধারের কথাও মনে পড়ল না কারও। এতই অবাঞ্ছিত তাঁরা!
কী ভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব? বলা দরকার, একান্ত বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া মানসিক রোগীকে তার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন করা নিষ্ঠুরতার। অবশ্য অনেক সময় পরিবারও খুব আতান্তরে পড়ে, বিশেষত নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি। ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে রেখে চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের মতো পরিকাঠামো আমাদের চার পাশে বিরল। এখানেই রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আসে। সমানুভূতির ভিত্তিতে, ক্ষমতার চেনা ছকের বাইরে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। এ ধরনের সংস্থায় আধুনিক নিয়ম-নীতি প্রচলন করা বিশেষ জরুরি। স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শন দরকার। হোম কর্তৃপক্ষ এবং কর্মীদের কর্তব্য এবং আচরণবিধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ এবং সে প্রশিক্ষণের ফলো-আপ জরুরি। আর সর্বোপরি দরকার একটি সংবেদনশীল সামাজিক পরিবেশ, যে পরিবেশে আমার-আপনার মতোই গুড়িয়াদেরও আছে পূর্ণ মানুষের অধিকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.