প্রবন্ধ ১ ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
এ রাজ্যের পাহাড়ে বাংলা ভাষা থাকবে না?
মন মানুষ কি আছে কোথাও, যে মাঝে মাঝে নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে না? সেই সব অনেক কথাই নিজের স্ত্রী বা স্বামীকে কিংবা মাকে, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও বলা যায় না প্রকাশ্য উচ্চারণে। সে সব কথাই মনের মধ্যে গোপন থেকে যায়।
আমি তো যখন তখন মনের সঙ্গে কথা বলি। কখনও মনের মধ্যেই একটা তর্কযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অনেক চিন্তাই নিছক একমুখী হয় না। নানান শাখায় বিভক্ত হয়ে গোলমাল পাকায়। তার পর ঘুম আসে, তার পর স্বপ্নের মধ্যে এসে যায় অন্য একটা জীবন। স্বপ্নের কথা থাক, সেই সব মনে মনে কথার কয়েকটা টুকরো আজ প্রকাশ্যে, লিখিত ভাবে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা হল। অবশ্যই একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে। লিখছি এই জন্য যে, আমি যা ভাবি, তা অন্য মানুষরাও কি সেই বিষয় নিয়ে ভাবে, এটা জানতে খুব কৌতূহল হয়। যেমন, বাঙালিরা কি আবার একটা বঙ্গভঙ্গ চায়? উনিশশো পাঁচ সালে ইংরেজরা একবার বাংলাদেশকে ভাঙতে চেয়েছিল। তার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম ও শেষ বার রাস্তায় নেমে, খালি পায়ে হেঁটে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। কয়েক বছর পর ইংরেজরা সেই বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়েছিল। আবার সাতচল্লিশে, এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ইংরেজরা যাকে বলে পার্টিং কিক হিসেবে বাংলা ও পঞ্জাবকে ভাগ করে দিয়ে যায়। অবশ্য সে সময়ের এ রাজ্যের বাঙালিদের এবং সর্বভারতীয় নেতাদের অদূরদর্শিতা বা মূর্খতাও অনেকটা দায়ী। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথকে তা দেখে যেতে হয়নি। তিনি তার আগেই চলে গিয়ে বেশ করেছিলেন।
সেই দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গের ক্ষত কিন্তু এখনও মিলিয়ে যায়নি, বরং দগদগ করে। আমাদের এখনকার অনেক সমস্যার মূলেই আছে সেই বঙ্গভঙ্গ। এখন কি আমরা আবার এই পশ্চিমবাংলা থেকে খানিকটা করে অংশ কেটে নিয়ে গোর্খাল্যান্ড কিংবা কামতাপুরী গড়ার প্রস্তাব মেনে নেব? তার আগেই আমি চলে যেতে চাই। তার বেশি দেরি নেইও বোধহয়। কোথায় চলে যাব? বিস্মৃতির অনন্ত অন্ধকারে?
পাশাপাশি। দার্জিলিঙে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুঙ্গ।
একটা রাজ্যের আয়তন যত ছোট হয়ে যায়, ততই সর্বভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সে রাজ্যের গুরুত্বও কমতে থাকে। তা তো সবাই জানে। স্বাধীনতার আগে অখণ্ড বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, ব্যবসা বাণিজ্যে, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বাংলার স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। এখন তা হু হু করে নীচে নেমে যাচ্ছে। এখনই ভারতের অনেক অংশে, বিশেষত উত্তর ভারতে, হতমান বাঙালিদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা তামাশা হয়। যাক, এ কথাটা তো খুবই সত্যি যে, পাহাড় অঞ্চলের উন্নতির উদ্যোগ অন্যান্য জায়গার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কাছাকাছি বেশ কিছু অঞ্চলকে আমরা সমতলবাসীরা ভেবেছি অপূর্ব মায়াময় বেড়াবার জায়গা এবং আরও আরও অনেক কিছু। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের নানান সমস্যা নিয়ে আমাদের কোনও সরকারও বিশেষ মাথা ঘামায়নি। তিরিশ চল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের পানীয় জলের অভাবের কথা শুনেছি। এখনও তা শোনা যায়। যাতায়াত ব্যবস্থারও তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। এর মধ্যে পাহাড় জেগেছে, সেখানে তৈরি হয়েছে স্থানীয় দল, তারা অনেক রকম দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন প্রবল ভাবে শুরু করেছে। এবং প্রথম প্রথম এই ধরনের আন্দোলন বেশি বিশ্রী ও হিংস্র হয়। তাই খুনোখুনি ও কথায় কথায় বন্ধ। ক্রমশ এই আন্দোলনের নেতৃবর্গ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এই পদ্ধতিতে কোনও দাবি আদায় করা যায় না। আমরা পাহাড়ের নানান দাবির অনেকগুলিরই সমর্থক। শুধু একটি ছাড়া। পশ্চিমবাংলার মানচিত্রের কিছু কিছু অংশ ছুরি দিয়ে কেটে আলাদা রাজ্য গড়া যাবে না। কিছুতেই না। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পেলে তাঁরা নিজেরাই অনেক দাবি মিটিয়ে ফেলতে পারবেন।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই পাহাড় অঞ্চলে যাচ্ছেন, ওখানকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাতে যুদ্ধং দেহি ভাবটা নেই। বেশ একটা খোলামেলা ভাব তৈরি হয়েছে। সেটা বেশ ভাল ব্যাপার। মুখ্যমন্ত্রীর এই চঞ্চলতার সঙ্গে দৃঢ়তা মিশ্রিত ব্যবহার সত্যিই খুব প্রশংসা করার মতো। পাহাড়ের নেতারা অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর এই কূটনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না। তাঁরা তাঁদের বাঘনখ লুকিয়ে রাখছেন এবং কিছু কিছু গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করছেন তাঁদের আপনজন। তবে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি নেতাদের কেউ কেউ বলে ফেলছেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবি তাঁরা আপাতত মুলতুবি রাখছেন বটে, কিন্তু সেই মূল দাবি থেকে একটুও সরছেন না। এই উক্তির একটা গূঢ় অর্থ এই হতে পারে যে, মুলতুবির এ সময় তাঁরা ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন।
মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ি নেতাদের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলেন? কোনও সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে দেখলাম, বৃহৎ জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রথম কয়েকটা বাক্য বলেন, নেপালি ভাষা। সেটা তো খুবই চমৎকার, সব মানুষই নিজেদের মাতৃভাষা অন্য কোনও ভাষাভাষীর মুখে শুনলে খুশি হয়। এক সময় সাহেবরাও যেমন কিছু কিছু বাংলা শিখে নিতেন। তার পর মুখ্যমন্ত্রী মূল বক্তৃতা দেন কোন ভাষায়? কোনও প্রতিবেদনেই আমি তার উল্লেখ দেখিনি। হিন্দি না ইংরাজিতে? বাংলা বললে তো ওরা প্রায় কেউই বুঝবে না। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজের রাজ্যেরই কিছু নাগরিকের সামনে নিজের ভাষায় কথা বলতে না-পারেন, সেটাকে আমি শুধু দুর্ভাগ্যজনক বলে মানতে রাজি নই তা অত্যন্ত গ্লানিজনক!
দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে দেখি, পাহাড়ের বিশিষ্ট নেতারা সরকার পক্ষের বিভিন্ন মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলছেন হিন্দিতে কিংবা ইরেজিতে। তাঁরা একটাও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেন না। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের এত বিরাগ কেন? আমরা জানি না, এই সব নেতা কি এই প্রজন্মেই নেপাল থেকে এসেছেন, না কয়েক পুরুষ ধরে আছেন এখানে, তাঁরা ভূমিপুত্র? যদি এই জন্মেই নেপাল থেকে এসে থাকেন, তবে তাঁদের কোনও দাবিতেই কর্ণপাত করা উচিত নয়। আর যদি জন্ম, কর্ম এখানেই হয়ে থাকে, তা হলে তাঁরা এত দিনে একটুও বাংলা শেখেননি? ভাইচুং ভুটিয়া এখানে খেলতে এসে দিব্যি বাংলা বলেন। এমনকী সাংমা যিনি রাষ্ট্রপতির পদের অন্যতম প্রার্থী, তিনি কিছু বছর কলকাতায় ছিলেন বলে কিছু কিছু বাংলা বলার চেষ্টা করেন। আর দার্জিলিঙের নেপালিরা এক বর্ণও বাংলা জানবেন না?
বেশ কিছু বছর আগে এক দিন দার্জিলিঙের নেপালি ভাষার এক সাহিত্যিক আক্ষেপের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, আমি স্কুলে বাংলা পড়েছি, তাই আমি রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে পারি। বাংলা ভাষায় যে অনেক বিশ্বমানের রচনা আছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখনকার নেপালি ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে বাংলা পড়ে না। তাই তারা বাংলা সাহিত্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর জন্য আপনারাই দায়ী। এখনকার পাহাড়ি অঞ্চলের স্কুলগুলিতে বাংলা পড়া লেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে কলকাতার কিছু কিছু স্কুলে বাংলা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় আছে, তা জানি।
সেই জন্য আমরা এ রাজ্যের সব স্কুলে অন্তত ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলা পাঠকে আবশ্যিক করার জন্য এক সময় আন্দোলন করেছি। বাংলা ভাষার অনেক প্রসিদ্ধ লেখক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কিছু কিছু পথ আমিও হেঁটেছি এই দাবি নিয়ে বিভিন্ন মিছিলে। ভারতের অনেক রাজ্যেই এই ব্যবস্থা আছে। মহারাষ্ট্রের সব স্কুলে মরাঠি ভাষাকে অন্যতম বিষয় হিসাবে নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই প্রসঙ্গ নিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছি। মুম্বই শহরের গুজরাতিরা যে একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী, তা সবাই জানে। এঁদের দ্বারা পরিচালিত কিছু কিছু স্কুলে মরাঠি ভাষার বদলে গুজরাতি ভাষা পাঠ্য। তা নিয়ে মহারাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে এই সব স্কুলের কর্তৃপক্ষের অনেক রকম মামলা মকদ্দমা হয়। শেষ পর্যন্ত তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের রায় মহারাষ্ট্রের সরকারের পক্ষেই যায়। রায় দিয়ে বিচারক মন্তব্য করেছিলেন, কোনও রাজ্যে যদি অন্য রাজ্য থেকে কেউ এসে চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য থাকতে চান, তা হলে তাঁদের এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও সেই রাজ্যের ভাষা শিক্ষা করা আবশ্যকীয় হওয়া উচিত। নইলে তাঁরা সেই রাজ্যের প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজনের সঙ্গে সাবলীল ভাবে মেলামেশা করতে পারবেন না।
আমরা পশ্চিম বাংলায় এই নীতি প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছি। কিছু রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও গেছি দাবিপত্র নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বুঝেছি, তাঁরা কেউই নীতিগত ভাবে এর বিরোধী নন, তাঁরাও বাংলা সাহিত্যকে ভালবাসেন। তবু কেন যে তাঁরা ইতস্তত করছিলেন, এই নীতি কার্যকর করতে পারেননি, তা আজও আমার বোধগম্য নয়।
রাজ্যে এখন নতুন সরকার এসেছে। তারা বাংলা ভাষা প্রচারের জন্য এই শিক্ষা নীতি স্কুলে প্রবর্তন করার
উদ্যোগ নিতে পারে না? এই নিয়ে যদি আন্দোলন করতে হয়, তবে সে দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। আমাদের অনেকেরই এখন অন্তরালে চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.