রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের যৌথ উদ্যোগে জোয়ার আসতে চলেছে কাঁথির কাজু শিল্পে।
জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার জেরে বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগ সম্ভব না হওয়ায় এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারেই জোর দিচ্ছে নতুন রাজ্য সরকার। চলতি বছরের প্রথম দিকে ‘কাঁথি কাজু গুচ্ছ শিল্প’কে স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রি ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট-এর আওতায় আনার জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করে রাজ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর। প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার সেই প্রস্তাবে সায়ও দিয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পরে এই প্রকল্পে ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার।
রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “কাজুর মতো তাঁত, চুল, কাঁসা, মাদুর-সহ দুই মেদিনীপুরের আরও কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জোয়ার আনবে পারব বলে আশা করছি।”
কাঁথি-১ ব্লকের দুলালপুর ও রাইপুর এবং কাঁথি-২ ব্লকের বসন্তিয়া পঞ্চায়েত এলাকায় (এ ছাড়াও রামনগর-১ ব্লকের কাঁটাবনি গ্রামে) গত কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে কাজু শিল্প। বড়, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে প্রায় চারশোটি কারখানা আছে। আর এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। যাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু পুরুষ ও মহিলার সংখ্যাই বেশি। কারখানা ছাড়াও অনেকে বাড়িতে বসে কাজু ভাজা, কাটা, ছাড়ানো, প্যাকেট করার কাজ করেন। বছরে প্রায় ৪০ টন বিক্রয়যোগ্য কাজু উৎপাদন হয় কাঁথিতে। কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ না-হওয়ায় এই শিল্পে খুব বেশি লাভের মুখ দেখতে পান না ব্যবসায়ীরা। মজুরিও কম জোটে শ্রমিকদের। পুরনো প্রযুক্তির কারণে ভিন্ দেশে রফতানির উপযুক্ত গুণগত মানেও পৌঁছতে পারে না কাঁথির কাজুবাদাম।
কাঁথিতে কাজু শিল্পের যে বিরাট সম্ভাবনা আছে, তা বুঝে প্রায় এক দশক আগে সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ২০০৫ সালে কাঁথি কাজু গুচ্ছ শিল্প গড়ে তোলার জন্য বাম সরকার উদ্যোগী হয়। তবে, বাস্তবে কাজ আর এগোয়নি। পরে অবশ্য (২০১০ সালে) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী সনৎ মুখোপাধ্যায় উদ্যোগী হয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছিলেন।
কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক মানস করমহাপাত্র বলেন, “গুচ্ছ শিল্প করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে কন্টাই কাজু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গড়া হয়। যুক্ত হন ১৮০টি কারখানার মালিক। সরকারি মউ অনুযায়ী, সংস্থার লভ্যাংশ এই শিল্পেই পুনর্নিয়োগ করতে হবে। ধীরে ধীরে এই শিল্পের জন্য ১৩৪ ডেসিমেল জমি কেনা হয়েছে। সেখানেই গড়ে উঠেছে এই গুচ্ছ শিল্পের কারখানা।” কন্টাই কাজু ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ আনোয়ারউদ্দিন ও সম্পাদক শেখ আশরাফউল্লা বলেন, “কাঁথিতে এই শিল্প এখনও চলছে গতানুগতিক ভাবে। উন্নত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। লাভ কমছে। গুচ্ছ শিল্প হলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি উপকৃত হবেন শ্রমিকরাও। কোনও বন্ধক ছাড়াই স্বল্প সুদে ও স্বল্প মেয়াদে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে।”
সাবেক পদ্ধতিতে ভাজা ও খোসা ছাড়ানোর সময় প্রায়শই কাজু ভেঙে যায়, নষ্ট হয়। ফলে আর্থিক ক্ষতি হয়। বহির্বিশ্বে কাজুর ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রফতানিযোগ্য গুণগত মানে পৌঁছতে পারে না কাঁথির কাজু। উন্নত প্রযুক্তিতে মেশিনে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কমবে। খোসাকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে কাজু ভাজা হয় সাবেক পদ্ধতিতে। নতুন প্রযুক্তিতে কাজুর খোসা থেকে তেল নিষ্কাশন করা হবে ও অবশিষ্টাংশ সার হিসাবে ব্যবহার করা হবে। উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি চটকদার প্যাকেজিং-এ জোর দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সবের জন্য শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও ভাবছে রাজ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর। দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর বিপ্লব রায়চৌধুরী বলেন, “কাঁথির কাজু শিল্পকে গুচ্ছশিল্পে পরিণত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রকের স্টিয়ারিং কমিটি প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে। বিস্তারিত প্রকল্প বিবরণ পাঠালে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যাবে।”
কাজু ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত কন্টাই কাজু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য অনন্ত ঘোষ, কমলেন্দু দাসদের দাবি, ‘‘গুচ্ছ শিল্পের জন্য সরকারি শর্ত পূরণের লক্ষ্যমাত্রায় আমরা প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। কাজু শিল্পের স্বার্থে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা জোটবদ্ধ হয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর।” |