|
|
|
|
বিকল্পে জোর কৃষি-দফতরের |
ঘাটতি-বৃষ্টি, ধান চাষে বিপর্যয়ের আশঙ্কা |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
২০১০-এ খরা-পরিস্থিতি হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরে। ২০১০-এর অল্প বৃষ্টিপাতের রেকর্ডকেও হার মানাচ্ছে এ বারের খামখেয়ালি আবহাওয়া। ২০১০-এর জানুয়ারি থেকে ১২ জুলাই (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৫২০.৪ মিলিমিটার। এ বার তা ১০০ মিলিমিটার কমে দাঁড়িয়েছে ৪২০ মিলিমিটারে!
ফলে এ বারের বর্ষায় আমন ধানের চাষ কতদূর কী হবে--তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন চাষিরা। যদিও জেলা কৃষি দফতর এখনও আশাবাদী। কৃষি দফতরের মতে, যদি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেও ভারী বৃষ্টি হয় তা হলে আমন চাষে ততটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেও যদি ভারী বর্ষণের দেখা না মেলে তা হলে বিকল্প পথে হাঁটতে হবে। তখন তিল, কলাই, মুগ, ভুট্টার মতো চাষেই উৎসাহিত করতে হবে চাষিদের। অনাবৃষ্টি হলে কোথায় ও কত একর জমিতে এই বিকল্প চাষ করা যেতে পারে সেই তথ্য-সংগ্রহও শুরু করেছে কৃষি দফতর। দফতরের তথ্য-আধিকারিক দুলাল দাস অধিকারী বলেন, “যদি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই ভারী বর্ষণ না হয় তা হলে আমন চাষ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন বিকল্প চাষ ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বিকল্প চাষের বিষয়ে চাষিদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কোথায় কত পরিমাণ জমিতে সেই চাষ করা যেতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
বর্ষার সময়ে সাধারণত, দু’ধরনের ধানের চাষ হয়। একটি আউশ, অন্যটি আমন। যদিও ধীরে ধীরে আউশ-আমনের ফারাক ঘুচতে চলেছে। যে সব এলাকায় শীতে আলু বা সব্জি চাষ হয়, সেখানে হারিয়ে যেতে বসছে আউশ চাষ। |
|
বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে বীজতলা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল |
কিন্তু বন্যা-প্রবণ এলাকা বা শীতে আলু চাষ হয় না এমন এলাকায় আউশ একটি গুরুত্বপূর্ণ চাষ। মূলত, এপ্রিল মাসের শেষদিক থেকে আউশ ধান চাষ শুরু হয়। জুন মাসে বর্ষা নামলে শুরু হয় আমন চাষ। ধান রোওয়া চলে ১৫ অগস্ট পর্যন্ত। যদিও সময়ে বর্ষা নামলে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই চাষিরা রোওয়ার কাজ শেষ করার চেষ্টা করেন। এ বার আউশ ধান ২৮ শতাংশ রোওয়া গেলেও আমন রোওয়া হয়েছে নগণ্য। কারণ বৃষ্টির অভাব। রোওয়া তো অনেক দূরের কথা বৃষ্টির অভাবে বীজতলা ফেলার কাজও সম্পূর্ণ করা যায়নি। কৃষি দফতর জানিয়েছে, আউশ ধানের বীজ-তলা ফেলার কাজ ৯২ শতাংশ হলেও আমন ধানের বীজতলা তৈরির কাজই হয়েছে মাত্র ৫৭ শতাংশ! আবার যে বীজতলা লাগানো হয়েছে, বৃষ্টির অভাবে তাও মরতে বসেছে। ফলে কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি নামলেও যে ধান-রোপণে জেলা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না--তা সহজেই অনুমেয়। কারণ, তখন চাষ করার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলেও বীজতলা পাওয়া যাবে না।
কেন এমন হল? কৃষি দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ২৭ বছরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫২৪.৭ মিলিমিটার। গত দশ বছরে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫১৬.৯ মিলিমিটার। যা বিগত ২৭ বছরের প্রায় কাছাকাছি বলা যায়। ২০১০ সালে, যে বছর খরা হয়েছিল, সে বছরে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১০০১.১ মিলিমিটার। ২০১১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৭১৭.৯ মিলিমিটার। যা ২৭ বছরের গড়কেও হার মানিয়েছিল। কিন্তু এ বছর? গত ২৭ বছরের হিসাব ধরলে ১২ জুলাই পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮২১ মিলিমিটার। গত ১০ বছরের হিসাবেও ১২ জুলাই পর্যন্ত গড় বৃষ্টি হয় ৮৩৮ মিলিমিটার। সেখানে চলতি বছরে ১২ জলাই পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ মাত্রই ৪২০ মিলিমিটার। যা বিগত বছরগুলির গড়ের প্রায় অর্ধেক! স্বাভাবিক কারণেই তার প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। আউশ ধানের বীজতলা তৈরির কাজ ৯২ শতাংশ হলেও আমন ধানে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এটাই জেলার প্রধান চাষ। সাধারণভাবে জেলায় ৪৯ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে বীজতলা হয়। গত বছর ১১ জুলাই পর্যন্ত বীজতলা পড়েছিল ৩৩ হাজার ৭৪৫ হেক্টরে। চলতি বছরে এই সময় পর্যন্ত বীজতলা পড়েছে মাত্র ২৮ হাজার ১২ হেক্টরে।
সাধারণভাবে জেলায় আউশ ধানের চাষ হয় ৫৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে (গত বছর হয়েছিল ৫৫ হাজার ৫১৭ হেক্টরে)। এ বার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার হেক্টর। গত বছরে ১১ জুলাই পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫৮৭ হেক্টর জমিতে রোওয়া হয়ে গেলেও এ বার হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ২০২ হেক্টরে। আর সাধারণভাবে জেলায় আমন ধানের চাষ হয় ৪ লক্ষ ৯০ হাজার ৪৮৪ হেক্টরে (গত বছর হয়েছিল ৫ লক্ষ ৫২৫ হেক্টরে)। এ বার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, ৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ হবে। গত বছর ১১ জুলাই পর্যন্ত যেখানে ১৯ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল এ বার সেখানে চাষ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে! সব মিলিয়ে খরিফ-চাষে কৃষি দফতরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার হেক্টর (গত বছর হয়েছিল ৫ লক্ষ ৪৪ হাজার ৯৮৪ হেক্টরে)। গত বছর ১১ জলাই পর্যন্ত যেখানে খরিফ-ধান রোওয়া হয়েছিল ৪৯ হাজার ৯৪২ হেক্টরে, সেখানে চলতি বছরে রোওয়া হয়েছে মাত্রই ২২ হাজার ৯৭ হেক্টরে!
স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, বৃষ্টিপাত কম হলে বা দেরিতে বৃষ্টি হলে ধান-চাষিরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেরিতে বর্ষা নামলে অনেকেই নিয়ম না মেনে সেপ্টেম্বর মাসেও রোওয়ার কাজ করেন। তবে দুলালবাবুর কথায়, “দেরিতে ধানের চাষ করলে ফলন ভাল হয় না। দেরিতে বৃষ্টি হলেও চাষিরা বাড়িতে বসে থাকতে না পেরে চাষ করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই আমাদের বিকল্প চাষের উপরেই গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে হয়।” |
|
|
|
|
|