বাধা এসেছে বারবার। পিছু হটেননি পাঁচ জন। সাত বছর ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করার পাশাপাশি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখেছেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সামান্য বেতন থেকে জমানো টাকা দিয়ে জমি কিনেছিলেন কেতুগ্রামের চরসুজাপুরের মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের পাঁচ শিক্ষক-শিক্ষিকা। সর্বশিক্ষা অভিযানের টাকায় সেখানে গড়ে উঠেছে কেন্দ্রের নিজস্ব দোতলা ভবন। তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না তাঁরা। এখন লক্ষ্য, গ্রামে যেন কোনও স্কুলছুট না থাকে, সবাই যেন স্কুলে আসে। |
নদিয়ার কালীগঞ্জ লাগোয়া এই চরসুজাপুর গ্রাম। সাত বছর আগে প্রথম স্কুল শুরু হয়। পাঁচ শিক্ষকের মধ্যে দু’জনের আবার সরকারি অনুমোদন নেই। তিন জনের বেতনই ভাগ করে নিচ্ছেন তাঁরা। স্কুল চালুর সময়ে গ্রামের একাংশ বলেছিলেন, “সরকারি স্কুল তো নয়! আসবে না কেউ পড়তে। সবাই যাবে কালীগঞ্জে।” শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানান, ২০০৫-এর ১৯ জুন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়। ২০০৬-এর ১০ মে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ থেকে অনুমোদন পায় স্কুলটি। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির মোট ৭০ জন পড়ুয়া নিয়ে শুরু হয় স্কুল। বছর দুয়েক এ ভাবে চলার পর গ্রামের একাংশের কাছ থেকে বাধা আসতে থাকে। স্কুলের পড়ুয়া ও শিক্ষকদের প্রাথমিক স্কুলে ঢুকতেও বাধা দেওয়া হয়। চাপে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষও তাঁদের সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে বলেন। শিক্ষিকা লায়লা খাতুন বলেন, “সকালে প্রাথমিক স্কুলের ভবনে আমাদের স্কুল চলত। ওই টানাপোড়েনে আমাদের স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছিল।” কিন্তু হার মানেননি তাঁরা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে পড়ুয়াদের স্কুলে নিয়ে আসতেন। শিক্ষক মহম্মদ হাসিল শেখ বলেন, “বিনামূল্যে গৃহশিক্ষকতা করলে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো হবে, অভিভাবকদের এই শর্তও আমরা পূরণ করেছি।” শিক্ষিকা সাহানারা খাতুনের কথায়, “সংসার ভুলে স্কুলের জন্য সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা অবধি বাইরে থাকতে হয়েছে। সেই পরিশ্রমের ফল আমরা এখন পাচ্ছি।”
এখন আর আগের মতো স্কুলছুট নেই এই গ্রামে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা হয় স্কুলে। পড়ুয়ার সংখ্যা ২১৬ জন। প্রতি মাসে স্কুলের শিক্ষিকারা অভিভাবিকাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। কোনও পড়ুয়া আসছে না দেখলে বাড়িতেই খবর পাঠান শিক্ষক-শিক্ষিকারা। রাস্তায় অভিভাবক বা পড়ুয়াদের দেখলেই বলেন স্কুলে আসতে। গ্রামের বাসিন্দা রফিক শেখ, আজিমুদ্দিন শেখ, মেহের শেখরা বলেন, “নিজেদের চেষ্টায় স্কুলটিকে দাঁড় করিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কেউ স্কুলে না গেলে অভিভাবকদের সচেতন করার কাজটিও সমান ভাবে করেন ওঁরা।”
শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানান, নিজেদের মাইনের টাকা জমিয়ে স্কুলের জন্য দু’দফায় সাড়ে ন’কাঠা জমি কিনেছেন তাঁরা। দাম পড়েছে প্রায় দু’লক্ষ টাকা। তাঁরা বলেন, ‘‘একেবারে শুরু থেকে আমরা ৫ জন ছিলাম। সে কারণে আমরা ৩ জনের ভাতা ৫ জনে ভাগ করে নিই। এখন গড়ে ৪৮০০ টাকা পাই।’’ স্কুলের জন্য ৫ কাঠা জমি দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা হাজি মহম্মদ জেহেদ। সেখানেই তৈরি হয়েছে স্কুল ভবন। প্রতিটি ঘরে রয়েছে বৈদ্যুতিন পাখার ব্যবস্থা। রয়েছে পানীয় জলেরও বন্দোবস্ত।
শিক্ষক আব্দুল ওয়াজেদ বলেন, “বর্ধমান জেলা সর্বশিক্ষা অভিযান থেকে দু’কামরা ঘরের জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কোনও ঠিকাদার নয়, নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে স্কুল ভবন তৈরি করিয়েছি আমরা। তাই দু’কামরা ঘরের জায়গায় দোতলা ভবন হয়েছে।” লায়লা খাতুন বলেন, “স্কুল ভবন তৈরি হওয়ার পরে আস্তে আস্তে পড়ুয়ারা আসতে শুরু করল। কিন্তু এক টুকরো মাঠ ছিল না স্কুলে। সে কারণে আমরা টাকা দিয়ে স্কুলের সামনের জায়গাটা কিনেছি।” স্কুলভবনের দোতলায় দাঁড়িয়ে আব্দুল ওয়াজেদ আলি বলছিলেন, “সামনের মাঠটা ভরাট করে দেব। ছোট্ট একটা বাগান থাকবে। পড়ুয়ারা খেলবে সেখানে।” আর প্রধান শিক্ষক মনসুরুল হক বলেন, “আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রথম শিক্ষার পাঠ নিচ্ছে। নজরে না রাখলে হারিয়ে যাবে। একদিকে স্কুল উন্নয়ন, তার পাশে ছাত্র বাড়াবার কাজ চালানো হবে। লড়াই এখনও শেষ হয়নি।” |