পাঁচ দিনের অসম লড়াই থেমে গেল। মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন দারা সিংহ। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ জুহুতে নিজের বাড়িতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। গত পাঁচ দিন মুম্বইয়ের এক হাসপাতালে আইসিইউ-তে ছিলেন তিনি। হৃদযন্ত্র ও কিডনি প্রায় বিকল হয়ে পড়ায় শেষ দু’দিন ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছিল তাঁকে। দেশের প্রথম ‘সুপারহিরো’র শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর সময়ে যেন নিজের বাড়িতেই রাখা হয় তাঁকে। সেই মতো কাল রাতে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার পর তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
পঞ্জাবের অমৃতসরে ১৯২৮ সালের ১৯ নভেম্বর এক জাঠ শিখ পরিবারে জন্ম হয় দীদার সিংহ রণধাওয়ার। পরবর্তী কালে দেশ যাঁকে এক ডাকে চিনেছিল দারা সিংহ নামে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চির সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী দারা কৈশোরেই ভালবেসে ফেলেছিলেন কুস্তিকে। সনাতন ভারতীয় ‘পহলওয়ানি’ কুস্তিতে পারদর্শী দারা প্রথম জীবনে বিভিন্ন মেলা, প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রাক স্বাধীনতা আমলে একাধিক রাজ্যের রাজা-রাজড়াদের সভায় কুস্তি প্রতিযোগিতাতেও অবশ্যম্ভাবী নাম ছিল দারার। |
মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই কুস্তিকে পেশা করে নেওয়া দারা এর পর পাড়ি দেন বিদেশে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একাধিক খেতাব জেতার পর যান ইউরোপে। দারার বিখ্যাত ‘দাও-প্যাঁচে’ একে-একে ধরাশায়ী হন তৎকালীন বিশ্বসেরা বহু কুস্তিগীর। অস্ট্রেলিয়ার কিং-কং, নিউজিল্যান্ডের জন ডি সিলভা, ও কানাডার জর্জ গর্ডিয়েঙ্কোকে হারানোর গল্প কুস্তিমহলে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। শোনা যায়, সেই সময় প্রায় ৫০০’র কাছাকাছি লড়াইয়ে এক বারও হার মানেননি তিনি। এর পর ১৯৫৯ সালে কলকাতায় কমনওয়েলথ কুস্তির আসরে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ১৯৭৬ সালে কলকাতাতেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে খালি হাতে নারকেল ফাটানোয় বিখ্যাত কুস্তিগীর ‘ব্রাউন বম্বারকে’ নক আউট করার স্মৃতি এখনও ভোলেননি অনেকেই।
কুস্তি থেকে সিনেমায় আসার গল্প দারা জানিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘মেরি আত্মকথা’য়। তাঁর কথায়, ১৯৫২ সালে কলকাতায় এক প্রযোজক দারাকে সিনেমায় আসার প্রস্তাব দেন। বিস্মিত দারা তাঁকে জানান, তিনি কোনও দিন সিনেমাই দেখেননি। অভিনয় করতে হবে না, শুধু ক্যামেরার সামনে সাজানো কুস্তি লড়বেনএই চুক্তিতে রুপোলি পর্দার জগতে পা রাখেন দারা। ১৯৫২’র ‘সঙ্গদিল’ থেকে ২০০৭-এ শেষ হিন্দি ছবি ‘জব উই মেট’, পাঁচ দশকের দীর্ঘ অভিনয় জীবনেও সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। হিন্দি, পঞ্জাবী, তেলুগু মিলিয়ে প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ভারতের এই ‘সুপারম্যান’। ছোট পর্দাতে রামায়ণের ‘হনুমান’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় আবালবৃদ্ধবনিতার তারিফ কুড়িয়েছিল।
১৯৮৫ সালে তাঁর সুপারহিট ‘মর্দ’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দারা সিংহ। সেই ছবির শু্যটিংয়ের প্রসঙ্গ তুলে এনে অমিতাভ আজ জানিয়েছেন, ভারতের প্রথম ‘সুপার-হিরো’ দারা সিংহ ছিলেন নিপাট ভাল মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান ঘটল। শাহরুখ খানও ট্যুইটারে দারাকে ‘দেশি সুপারম্যান’ বলে উল্লেখ করেছেন। দারার মৃত্যুর খবর পেয়ে সলমন খান এক মিনিট তাঁর ছবির শু্যটিং বন্ধ রেখে নীরবতা পালন করেন।
রাজনীতির আঙিনাতেও পা রেখেছিলেন দারা। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মনোনীত সদস্য ছিলেন তিনি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ তাঁকে ‘রুস্তম-ই-হিন্দ’ বলে ঘোষণা করেন।
আজীবন সুঠাম ভারতীয়দের ‘রোলমডেল’ ছিলেন দারা সিংহ। পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও থাকবেন, তবে এ বার ছবিতে, গল্পে, কথায়। |