জানতে ইচ্ছে হয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কোনও দিন সাবমেরিন চালিয়েছেন কি না। বা, না চালালে, সেই ইচ্ছে রাখেন কি না। গভীর সমুদ্রে লোহা-স্টিলের প্রাণীটি চলে নিঃশব্দে। একা। চারপাশে নিকষ নিঃসঙ্গতার বেড়াজাল কাটতে কাটতে। দেহ ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু এখনও। এখনও যেখানে গুলি লাগলে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ঝরে পড়ে। সাদা চোখে যা ধরা ততটটাই দুর্লভ। ‘দ্য ওয়ারিয়র প্রিন্স’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এই যুদ্ধের শেষ কোথায়? জগ করে আসছেন তিনি। একা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিশাল ব্রিজের দানবীয় রেলিং। কখনও জানতেন একা হাঁটাই হবে তাঁর সারা জীবনের পথ চলা? হিসেব দেখাবে সেই পথে কাঁটার পাল্লাই ভারি। ‘সোনার কেল্লা’য় শেষের দিকে সিংহজির সঙ্গে ট্যাক্সিতে করে জয়সলমির যাওয়ার রাস্তার মতো। অ্যাম্বাসেডার দু’পা যেতে না যেতেই কাঁচ। পেরেক। জাতীয় দলে প্রথম বার নির্বাচন হওয়ার পরই বাদ। তারপর চার বছর ঠান্ডা শীতঘুম। চাকা ফেটে চৌচির। তাই বলে ফেলু মিত্তিরের কিস্তিমাত থামেনি। সৌরভের ব্যাট-বল-ক্যাপ্টেন্সিও নয়। তাই বার বারই জাতীয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর রকেটের মতো উত্থান। তার পরই সজোরে মাটিতে আছাড়। আবার উত্থান... পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের মতোই পিলে চমকে দেওয়া প্যাশনেট গল্প।
সব থেকে নিষ্ঠুর কাঁটাটা অবশ্যই গ্রেগ চ্যাপেল। শেষ পর্যন্ত গ্রেগ এই তথ্যচিত্রে বলেছেন, “মে বি, আই অলসো কুড হ্যাভ ডান থিংস ডিফারেন্টলি”। এ বলা নিশ্চয়ই দাদার ফ্যানেদের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। সান্ত্বনাও। যে দগদগে ঘা নিয়ে সৌরভের চিরাচরিত নির্লিপ্ত মুখে মন্তব্য, “কোনও দিন বিশ্বাস করতাম না ক্রিকেটে এই সবও (পড়ুন নোংরামি) হয়। কিন্তু এটা শুধু ক্রিকেট নয়। ইট ওয়াজ অ্যান আই-ওপেনার ফর মি ইন লাইফ।”
খিচখিচে কাঁটা শাহরুখ খানও। আইপিএল ২। সৌরভের বেলায় নিলামের হাতুড়ি যে বার স্থির। শট-এ পাশাপাশি বসে এসআরকে-সৌরভ। কিন্তু মাঝখানে যেন চিনের প্রাচীর। ফটোগ্রাফ কখনও মিথ্যা বলে না। আলিঙ্গনও যে কতটা ঠান্ডা হতে পারে, সেটাও ফ্রেম-বন্দি করেছেন পরিচালক মিতালি ঘোষাল। |
ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার সূত্রে মিতালি লেন্স-বন্দি করেছেন অনেক দুর্লভ মুহূর্ত। “তখন রঞ্জি চলছে। ২০০৫। সৌরভ আবার দল থেকে বাদ। এক দিন দেখি বেহালার রেলের মাঠে ঠা-ঠা দুপুরবেলা সৌরভ তিরবেগে পাগলের মতো ছুটছেন। সঙ্গে শুধু ছোট্ট সানা,” বলছেন মিতালি। সৌরভ পরে বলেছিলেন ওই পাগলের মতো একান্তে দৌড় তাঁকে কী ভাবে ইন্ধন জুগিয়েছিল। মনকে ইস্পাত করে বাঁধতে। পরের যুদ্ধের জন্য।
সেই দৌড়ের ভাগিদার আরেক কিংবদন্তি। সচিন তেন্ডুলকর। সৌরভের সঙ্গে ঐতিহাসিক ওপেনিং পার্টনারশিপ। ক্রিজে দাঁড়িয়ে দু’জনের মাইন্ড রিডিং এমনই ছিল যে সৌরভ কোন শটটা ঠিক কী ভাবে খেলবেন সেটা সচিনের ঠোঁটস্থ ছিল। মারার পর সেটা নিয়ে দু’জনে মুচকি হাসতেন। “আমরা অনেক ছোটবেলা থেকেই তো একসঙ্গে ছিলাম। পরে ও যখন জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন হল, ওর মধ্যে একটা আক্রমণাত্বক মনোভাব দেখেছিলাম। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত আক্রমণ। প্রত্যেক প্লেয়ারের প্রধান অস্ত্র আর দুর্বল জায়গা ও জানত। সে ভাবেই ওদেরকে ট্যাক্ল করত,” বলছেন সচিন।
কিছু অতি পরিচিত দৃশ্য। লর্ডসে জার্সি খুলে ব্যাঘ্রগর্জন। প্রিয় ক্যাপ্টেনকে নিয়ে হরভজন, যুবরাজ, সহবাগদের এপ্রিল-ফুল-এর দুষ্টুমি। রাহল দ্রাবিড়ের সোজা কথা, “কোনও নম্বরের খাপে ওকে ফিট করে মাপা যাবে না।” অবসরের দিন কুম্বলের সেলাম, “তুমিই তো আমাদের আম্তর্জাতিক মঞ্চে সঠিক মাইন্ডসেট নিয়ে খেলতে শিখিয়েছিলে।” সৌরভের মেঘলা মুখে তিরতিরে হাসির ঝিলিক।
কিছু অপরিচিত। হোটেলের ঘর। নিভৃত কোণে আরাধ্য দেবতার নানা ছবি। মা নিরূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের আদুরে গল্প, “খাওয়ার কোনও হ্যাপা ছিল না। ছোটবেলায় আলুভাতে ভালবাসত। বিরিয়ানিও।” ডেটিংয়ের স্মৃতি ধরে স্ত্রী ডোনার সলজ্জ মম্তব্য, “ও-ই বলুক এ ব্যাপারে”। অনুপম রায়ের গান, “সময়ের সাথে বুঝিয়ে দিয়েছ তুমি-ই মহারাজা,” উস্কে দেয় চেনা আবেগ। মিউজিক-ও তাঁর।
সমস্ত ঘটনা বলিষ্ঠ তারে বেধেঁছেন আর এক লেজেন্ড। অমিতাভ বচ্চন। সৌরভের প্যাশন আর যুদ্ধকে যিনি তাঁর গভীর ব্যারিটোনের খাদে ঢেলে এক অন্য অস্তিত্ব দিয়েছেন। ভয়েস ওভার-এ তাঁর স্বর, “আ ওয়ারিয়র নেভার ডাইজ টিল হিজ ডেথ,” গায়ে কাঁটা দেয়।
ক্রিকেটার কোনও দিন হতে চাননি। বরং মারাদোনারা রাতের ঘুম কেড়ে নিত। সেই জন্যেই কি ক্রিকেটের ভাগ্যদেবী সুদে-আসলে গুরুদক্ষিণা উসুল করে নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে? বার বার? ‘মহারাজ’ তিনি ঠিকই। কিন্তু নিছক সিংহাসনে বসে রাজত্ব চালাবার শখ নেই তাঁর। রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁটে আছে যুদ্ধসাজ। দ্য ওয়ারিয়র। প্রিন্স। |